প্রবাসে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে সফল হওয়া সিলেটের এক নারীর গল্প

প্রকাশিত: ৭:৪৭ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৪ | আপডেট: ৭:৪৭:অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৪

জাহাঙ্গীর আলম খায়ের, সিলেট

বর্ণবাদিরাও দমিয়ে রাখতে পারেনি আশরাফিয়া খানম (৮২) নামের বাঙালী এক নারীকে। তিনি সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার উমরপুর ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের বাসিন্দা ও যুক্তরাজ্যের নিউ ক্যাসল আপন টাইন সিটি কাউন্সিলের সাবেক লর্ড মেয়র হাবিবুর রহমান হাবিবের মা। তার স্বামী আজিজুর রহমান ওরফে মনু মিয়া দর্জি ১৯৭৭ সালে যুক্তরাজ্যের ইংলিশ বর্ণবাদিদের হাতে খুন হন। বর্ণবাদিদের লাঞ্চনা-বঞ্চনা সহ্য করে লেখাপড়া করিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন ছেলেদের। এক পর্যায়ে যে শহরে তাঁর স্বামী খুন হয়েছেন সেই শহর কাউন্সিলের লর্ড মেয়রের চেয়ারে ৪র্থ ছেলে হাবিবুর রহমান হাবিবকে বসিয়ে ইতিহাসের জন্ম দেন এই মা।

 

শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারি) সকালে  ওসমানীনগরের উমরপুর ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে বয়োবৃদ্ধ আশরাফিয়া খানম ছেলে সাবেক লর্ড মেয়র হাবিবুর রহমান হাবিব ও নাতি হামজা রাহিমের পাশে বসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় নিজের জীবনের কঠিন বাস্তবতা ও সফলতার গল্পগুলো তুলে ধরেন।

 

 

তিনি জানান, ১৯৬১ সালে আজিজুর রহমান ওরফে মনু মিয়া দর্জির সাথে তাঁর বিয়ে হয়। স্বামীর দর্জি ব্যবসায় চলতো তাদেও সংসার। ব্যবসার পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজ করতেন তার স্বামী। ১৯৬৩ সালে স্বামী  যুক্তরাজ্যে গিয়ে  লন্ডন শহরের একটি কাপড়ের কারখানায় কাজ শুরু করেন। স্বামীর আয় দিয়ে ভালোই কাটছিল তাদের সংসার জীবন। প্রতি বছর তিনি দেশে আসতেন। সংসার জীবনে ৫ছেলে সন্তানের পিতামাতা হন তাঁরা। এরপর ১৯৭৭ সালে তাঁর স্বামী লন্ডন শহর থেকে নিউক্যাসল আপন টাইন শহরে চলে যান। সেখানে তার বড় ভাই আতাউর রহমান ওরফে সুনু মিয়ার সাথে যৌথভাবে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করেন। রেস্টুরেন্টে তিনি ম্যানাজারের দায়িত্বে ছিলেন। রেস্টুরেন্টে কাজ শুরুর কয়েক দিন পর এক রাতে সাদা ইংলিশ বর্ণবাদীর হাতে ছুরিকাঘাতে তার স্বামী খুন হন।

 

ওয়াহিদ উদ্দিন আহমদ কুতুব নামের এক মহান ব্যক্তির প্রচেষ্ঠায় ৪৬ দিন পর স্বামীর লাশ দেশে এনে দাফন করা হয়।  স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। ছোট সন্তানদের নিয়ে খেয়ে বেঁচে থাকা তাঁর জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। একপর্যায়ে তাঁর বড় ভাইয়ের প্রচেষ্ঠায় সন্তানদের নিয়ে যুক্তরাজ্যে যেতে সক্ষম হন তিনি। সেখানে গিয়ে শুরু হয় তাঁর নতুন যুদ্ধ। অচেনা আজানা জায়গায় ছেলেদের নিয়ে কষ্টেই কাটছিল তাঁর জীবন। এশিয়ান কালো ও মুসলিম বলে অনেক সময় রাস্তায় বের হলে সাদা বর্ণবাদীদের দ্বারা তিনিসহ তার ছেলেরাও লাঞ্চনার শিকার হতে থাকেন।

 

তবে, শেষ পর্যন্ত ছেলেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারায় তিনি আজ গর্বিত। বিশেষ করে ৪র্থ ছেলে হাবিবুর রহমান লর্ড মেয়রের চেয়ারে বসার পর তিনি অত্যন্ত খুশি হন। সেদিন তিনি তার স্বামী হত্যাকারীকে মনে প্রাণে ক্ষমা করে দিয়ে ছেলেদেরও ক্ষমা করে দিতে বলেন। হাবিবুর রহমান বর্তমানে নিউ ক্যাসল আপন টাইন সিটি কাউন্সিলের কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

 

কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, নিউক্যাসল এলাকায় লেখাপড়া করাকালীন সময়ে কালো এবং মুসিলম হওয়ার কারণে সাদা ইংলিশ দ্বারা অনেক লাঞ্চনা সইতে হয়েছে। কখনো ডিম ছুড়ে মেরেছে কখনো থুথু দিয়েছে কখনো আবার কিলঘুশি মেরেছে। বিষয়টি তাকে খুব পীড়া দিত। ১৯৯২ সালে প্রথম মায়ের কাছ থেকে পিতা হত্যার প্রকৃত ঘটনা জানার পর তিনি বর্ণবাদ দূর করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মায়ের দেয়া শিক্ষা থেকে হিংসা নয় ভালোবাসা দিয়ে এই জঘন্য কাজ দূর করার লক্ষে তিনি সেখানকার ইয়থ ক্লাবে কাজ শুরু করেন।

 

প্রথমদিকে একই সমস্যা পোহালেও আস্তে আস্তে সফল হন এবং লেভারপার্টির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ২০১০ সালে নিউক্যাসল আপন টাইন সিটি কাউন্সিলে নির্বাচন করে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৮ সালে ক্যাবিনেট ফোসট অর্জন, ২০১৯ থেকে ২০২১ পর্যান্ত  শেরিফ অ্যান্ড ডেপুটি লর্ড মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। আর ২০২১ সাল হতে ২০২২ সাল পর্যন্ত কাউন্সিলের লর্ড মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

 

বিগত ৮০০ বছরের মধ্যে নিউক্যাসল সিটিতে ইংলিশ ও খ্রিস্টান ছাড়া তিনিই প্রথম কালো ও মুসলিম বাংলাদেশি লর্ড মেয়র নির্বাচিত হয়ে সেদেশে নতুন ইতিহাস সৃস্টি করেন। আর এসকল সফলতা কেবল তিনি তার মায়ের দ্বারাই অর্জন করতে সক্ষম হন। ভবিষ্যতে মেয়র এবং পার্লামেন্টে নির্বাচন করার ইচ্ছা রয়েছে তার। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলি হামলার ব্যাপারে তার দলের নীতি নির্ধারকদের নীতি ভালো না লাগায় তিনি দল থেকে পদত্যাগ করে বাংলাদেশে ছুটি কাটাতে এসেছেন বলেও জানান তিনি।