৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ — আজ ভোর ৬:০০ টায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) চেয়ারপারসন ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘ অসুস্থতার পর ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে তার জীবনাবসান করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি মৃত্যুকালে ৮০ বছর বয়সে প্রিয় বাংলাদেশকে বিদায় জানালেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে খালেদা জিয়ার স্থাণ
১) প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাস গড়া
খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, যা একটি ঐতিহাসিক মাইলফলত। এই অর্জন বাংলাদেশে নারীর নেতৃত্বের পথকে দৃঢ় করেছে। 
২) সামরিক শাসনের পতনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা
জিয়াকে রাজনৈতিক নেতৃত্বে দাঁড়াতে হয়েছিল কঠিন পরিস্থিতিতে। তিনি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন ও সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যা ১৯৯০-এর দশকে গণতান্ত্রিক শক্তিকে পুনরায় সক্রিয় করেছে।
৩) শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে উদ্যোগ
প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি শিক্ষা উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তাঁর প্রশাসন মেয়েদের বিনামূল্যে শিক্ষা ও স্কলারশিপ বাড়িয়ে নেওয়ার মাধ্যমে নারীর শিক্ষায় অংশগ্রহণ বাড়াতে সহায়তা করেছে। 
৪) শিশুর পুষ্টি ও বস্ত্র শিল্পে অবদান
স্কুলে প্রতিদিন বিনামূল্যে খাবার কর্মসূচি আয়োজনের মাধ্যমে তিনি শিশুর পুষ্টি পরিস্থিতি উন্নয়নে অবদান রেখেছিলেন। এছাড়া রপ্তানি-ভিত্তিক গার্মেন্টস শিল্পের সম্প্রসারণের মাধ্যমে অর্থনীতিতে নতুন কর্মসংস্থান ও বিদেশী মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করেছেন।
⸻
নেত্রীত্ব ও ব্যক্তিত্ব: শক্তি ও ধৈর্য
১) সংগ্রামের মায়া
রাজনীতিতে প্রবেশের পর থেকে তিনি কখনো সহজ পথ নেয়নি। ১৯৮০-এর দশক থেকে শুরু করে বহু বার হজম হয়েছেন গ্রেফতার, বন্দিত্ব ও বাধার মুখে, তবুও দল এবং আদর্শের প্রতি তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস অটল ছিল।
২) কঠিন সময়ে স্থির নেতৃত্ব
দীর্ঘ কারামুক্তি পরেও তিনি দলকে সরিয়ে দেননি; কঠিন সময়ে দলকে সংগঠিত রেখে গণতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করেছিলেন। 
৩) প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সমর্থন ও যুক্তিহীন দেহাত্মক উত্তেজনা না বৃদ্ধি
আরও একটি স্মরণীয় দিক ছিল, যখন ক্ষমতাবিরোধী রাজনৈতিক সময়ে তিনি ধৈর্য ধরেছিলেন এবং দেশকে “প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি” থেকে দূরে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। 
⸻
খালেদা জিয়াকে দেশের রাজনৈতিক জীবনে একটি অনন্য ও শক্তিশালী নারীরূপে স্মরণ করা হবে, যিনি নিজেকে উচ্চচিন্তা, সংগ্রাম এবং নেতৃত্বের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার মৃত্যুতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, আন্তর্জাতিক নেতারা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং তাঁর জীবন ও সংগ্রামে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে রাজনৈতিক দল ও নেতাদের শোক
বিএনপির ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে খালেদা জিয়ার মৃত্যুর তথ্য জানিয়ে লেখা হয়, “বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আজ সকাল ৬টায় ফজরের ঠিক পরে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। আমরা তাঁর রূহের মাগফিরাত কামনা করছি এবং সকলের নিকট তাঁর বিদেহী আত্মার জন্য দোয়া চাচ্ছি।”
নিজের ফেসবুক পোস্টে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর লেখেন, “আমরা গভীর দুঃখের সঙ্গে আমাদের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে শোকাহত (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।”
শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক থেকে পোস্ট দিয়ে তিনি লিখেছেন, “ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ওপরে রহম করুন, ক্ষমা করুন এবং তার প্রিয় জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন। তার আপনজন, প্রিয়জন ও সহকর্মীদেরকে মহান আল্লাহ সবরে জামিল দান করুন। আমিন।”
শোক জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি লেখেন, “তিনি ছিলেন সব নেতার মধ্যে সবচেয়ে করুণাময় – আমাদের প্রতিরোধের প্রতীক এবং সর্বোচ্চ স্তরের একজন দেশপ্রেমিক। তিনি শেষ অবধি একজন যোদ্ধা ছিলেন। আমাদের সবচেয়ে কঠিন সময়ে আশার আলো। আজীবন সংগ্রামের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের প্রকৃত চেতনাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি ছিলেন আমার নায়ক।”
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, “স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাঁর সাহসী নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে এদেশের মানুষকে পথ দেখিয়েছে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুনরুদ্ধারে রেখেছেন অসামান্য ভূমিকা।”
“দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি বহুবার কারাবরণ করেছেন এবং চড়াই-উৎরাই পার করেছেন, কিন্তু নিজের রাজনৈতিক আদর্শ ও জনগণের অধিকারের প্রশ্নে তিনি ছিলেন অবিচল। দেশ ও জাতির সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ছিলেন আপোসহীন”, যোগ করেন তিনি।
আজকের দিনে বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বের মানুষের মনে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব, সংগ্রাম ও সংগ্রামী পরিচয় চিরস্থায়ীভাবে গেঁথে থাকবে। তিনি শুধুমাত্র একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না — তিনি নারীর ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও জাতির সংগ্রামকে প্রতিনিধিত্বকারী প্রতীক।

