সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় মাসে পাওয়া যাবে ৬৪ হাজার টাকা

প্রকাশিত: ১:৪৮ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২২ | আপডেট: ১:৪৮:অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২২

প্রস্তাবিত ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ প্রবর্তন হলে ১৮ বছর বয়সে যদি কেউ চাঁদা দেওয়া শুরু করে এবং ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত তা চালু থাকে তাহলে ওই ব্যক্তি অবসরের পর ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি মাসে ৬৪৭৭৬ টাকা পেনশন পাবেন। যদি ৩০ বছর বয়সে চাঁদা দেওয়া শুরু করেন এবং ৬০ বছর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে, তাহলে অবসরের পর প্রতি মাসে ১৮৯০৮ টাকা পেনশন পাবেন।

বুধবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভা শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রস্তাবিত ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’র বিভিন্ন দিক তুলে ধরতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেন।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ বিষয়ে প্রণীত কৌশলপত্রের ওপর অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন।

এ সময় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আহমদ কায়কাউসসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সিনিয়র সচিব ও সচিবরা উপস্থিত ছিলেন। প্রায় ৩২ পৃষ্ঠার খসড়া কৌশলপত্রে নতুন এই পেনশন ব্যবস্থার বিভিন্ন দিকসহ বিভিন্ন দেশে চলমান পেনশন ব্যবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।

জানা গেছে, ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ চালু করতে আলাদা একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিষয়ে আইন প্রণয়নসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হবে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে।

দেশের আপাময় জনসাধারণের জন্য একটি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নির্বাচনী ইশতিয়ারে। তার একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করে সেটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে।  খুব শিগগির এ বিষয়ে একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে অর্থ বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার আলোকে প্রণীত কৌশলপত্রটির ওপর প্রধানমন্ত্রী বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। এছাড়াও সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রর্বতনের লক্ষ্যে জরুরিভিত্তিতে একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য অর্থ বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছেন।

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তন হলো জাতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি উপহার। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় বৃদ্ধকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয়ভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার অনুযায়ী সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়।

প্রেস ব্রিফিংয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি চালুর সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এবং সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। সম্প্রতি কৌশলপত্রটি প্রধানমন্ত্রীর সামনে উপস্থাপন করা হয়। তিনি কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই নির্দেশনাগুলো অন্তর্ভুক্ত করে শিগগিরই একটি সর্বজনীন পেনশন আইন প্রণয়ন করা হবে।  আইন প্রণয়ন হলে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা পাওয়া যাবে। এটি নিয়ে আমরা এখন কাজ করছি।

মুস্তফা কামাল বলেন, বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বা জনসংখ্যাগত লভ্যাংশের সুবিধা ভোগ করছি। আমাদের বর্তমান গড় আয়ু ৭৩ বছর যা ২০৫০ সালে ৮০ বছর এবং ২০৭৫ সালে ৮৫ বছর হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় আগামী তিন দশকে একজন কর্মজীবী ব্যক্তি অবসর গ্রহণের পরও গড়ে ২০ বছর আয়ু থাকবে। বাংলাদেশে বর্তমানে নির্ভরশীলতার হার ৭.৭ শতাংশ, যা ২০৫০ সালে ২৪ শতাংশে এবং ২০৭৫ সালে ৪৮ শতাংশে উন্নীত হবে।  গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীল হার বিবেচনায় আমাদের বৃদ্ধ বয়সের নিরাপত্তা হিসেবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা খুবই জরুরি।

প্রস্তাবিত সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য দিক
১৮-৫০ বছর বয়সী সব কর্মক্ষম নাগরিক সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারবেন।  বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরা এ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীদের আপাতত নতুন জাতীয় পেনশন ব্যবস্থার বাইরে রাখা হয়েছে।  ভবিষ্যতে এ বিষয়ে সরকার যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে দেশের ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সব নাগরিক পেনশন হিসাব খুলতে পারবেন।  প্রাথমিক এ পদ্ধতি স্বেচ্ছাধীন থাকবে যা পরবর্তীতে বাধ্যতামূলক করা হবে। ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার সাপেক্ষে মাসিক পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন।   প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি পৃথক পেনশন হিসাব থাকবে ফলে চাকরি পরিবর্তন করলেও পেনশন হিসাব অপরিবর্তিত থাকবে। এ পেনশন পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানের অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকবে।  তবে এ ক্ষেত্রে কর্মী বা প্রতিষ্ঠানের চাঁদা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত হবে।

 

মাসিক সর্বনিম্ন চাঁদার হার নির্ধারিত থাকবে। তবে প্রবাসী কর্মীদের সুবিধার্থে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা জমা দিতে পারবে। সুবিধাভোগী বছরে ন্যূনতম বাৎসরিক জমা নিশ্চিত করবে।  অন্যথায় তার হিসাব সাময়িকভাবে স্থগিত হবে এবং পরবর্তীতে বিলম্ব ফিসহ বকেয়া চাঁদা দেওয়ার মাধ্যমে হিসাব সচল করা হবে। সুবিধাভোগী আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে চাঁদা হিসেবে বর্ধিত অর্থ জমা করতে পারবে। পেনশনের জন্য নির্ধারিত বয়সসীমা (৬০ বছর) পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জিভূত লভ্যাংশসহ জমার বিপরীতে নির্ধারিত হারে পেনশন দেওয়া হবে।

পেনশনাররা আজীবন অর্থাৎ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন। নিবন্ধিত চাঁদা জমাকারী পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মৃত্যুবরণ করলে জমাকারীর নমিনি অবশিষ্ট সময়কালের (মূল জমাকারীর বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) জন্য মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন। পেনশন স্কীমে জমাকৃত অর্থ কোন পর্যায়ে এককালীন উত্তোলনের সুযোগ থাকবে না। তবে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসাবে উত্তোলন করা যাবে যা সুদসহ পরিশোধ করতে হবে। কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে নিবন্ধিত চাঁদা প্রদানকারী মৃত্যুবরণ করলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ তাঁর নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে।

পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়কর মুক্ত থাকবে। এ ব্যবস্থা স্থানান্তরযোগ্য ও সহজগম্য। অর্থাৎ কর্মী চাকরি পরিবর্তন বা স্থান পরিবর্তন করলেও তার অবসর হিসাবের স্থিতি, চাঁদা প্রদান ও অবসর সুবিধা অব্যাহত থাকবে। নিম্ন আয়সীমা নিচের নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন স্কীমে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে প্রদান করতে পারে। পেনশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সরকার নির্বাহ করবে।   পেনশন কর্তৃপক্ষ ফান্ডে জমাকৃত টাকা নির্ধারিত গাইডলাইন অনুযায়ী বিনিয়োগ করবে।