অমরাবতির গল্প–(৩১)—মোঃ শেবুল চৌধুরী

প্রকাশিত: ১:০৯ পূর্বাহ্ণ, জুন ৮, ২০২৩ | আপডেট: ১:১০:পূর্বাহ্ণ, জুন ৮, ২০২৩

 

 

 

“অমরাবতি” শুধু যে বাগান বিলাসীদের ঠিকানা তা নয় ?বলতে গেলে “অমরাবতি” অনেকটা একান্নবর্তী পরিবারের মতো।বৃটেন, ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা,বাহরাইন, সৌদি আরব ও বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন অমরাবতির সদস্যরা।তাই অমরাবতির গল্প মানে জীবনের গল্প, বাস্তবতার গল্প, সবুজের গল্প, কৃষকের গল্প। আমি আজ আপনাদের জানাবো একজন ডাক্তারের গল্প। নাহ ভূল বললাম,পেশায় তিনি সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ এন্ড হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপিকা হলেও নেশায় একজন বাগান বিলাসী।শুধু তাই বিগত কয়েক বছর যাবত তিনি অমরাবতির সিলেট চাপ্টারের প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। আর কথা নয় আসুন জেনে নেই অমরাবতির সিলেট প্রধান ডাক্তার খূর্শিদা তাহমিন শিমু’র গল্পে। যিনি লিখলেন পরিবেশ ও তাঁর নিজের পারিবারিক পরিমন্ডল নিয়ে, অমরাবতির কর্মকান্ড নিয়ে।আসুন জেনে নেই কি রয়েছে ডাক্তার খূর্শিদা তাহমীন শিমু’র গল্পে।

 

 

 

অমরাবতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান আমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন গাছ পালা বা প্রকৃতির সাথে ভালোবাসা কখন, কি করে হলো?
উত্তরে বলি, ঠিক কখন হলো তা বলতে পারবো না । তবে
আমি জন্ম থেকেই বড় হয়েছি গাছ পালা ফুল পাখি এসবের মধ্যে। শহরের মধ্যে হলেও আমাদের বাসাটা গাছপালায় পরিপূর্ণ ছিল। আমার ফুফুরা বাগান করতেন। বিয়ের পরে অন্য বাড়িতে চলে গেলেও আমাদের বারান্দায় শোভা পেত তাদের হাতে লাগানো ফুল আর পাতাবাহার এর টব। সেই সময়ের লাগানো একটা কেকটাস( কাটামুকুট) এখনো আছে আমার কাছে‌‌। বৃদ্ধ, হয়তো ৬০ এর উপরে বয়স, এখনো নিয়মিত ফুল দিয়ে যাচ্ছে।আব্বার ও খুব পছন্দের ছিল, জবা, হাসনা হেনা, স্থলপদ্ম আর গোলাপী রঙের ঘাসফুল (রেইনলিলি)। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে নিজহাতে গাছের ডালপালা ছেঁটে দিতেন আর সারি বেঁধে রেইনলিলি লাগাতেন আমাদের শিলং পেটার্নের টিনশেড বাসার লম্বা বারান্দার ধার ঘেঁষে। জুলাই , অগাস্ট মাসে যখন একসাথে গোলাপী রং এর ফুলগুলো ফুটতো, অবাক করা দৃষ্টি নিয়ে দেখতাম ওদের ‌ । সারা বাড়ি জুড়ে সারিবেঁধে লাগানো ছিল নানা রঙের পাতাবাহার। কিছুদিন পরপর আব্বাই ছেঁটে দিতেন চা গাছের মতো করে। এসবের মধ্যে বড় হতে হতেই নিজেও ফুল পাতার ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ি‌। আব্বা মারা যাবার পর আমার বড় আপা আর সেজআপা করতেন গাছের দেখভাল।তখন এতো নার্সারি ছিলনা। যখন যেখানে যেতাম,নতুন গাছ দেখলেই সংগ্রহ করার চেষ্টা করতাম। আর আপামনি, আমার বড়আপা সেটা যত্ন করে বাগানে লাগাতেন। আমরা ভাই বোনরা একসাথে মিলে উঠোনের ঘাস ছাঁটতাম। এটা ছিল খুব একটা আনন্দের ব্যাপার। যেন এটাও ছিল আমাদের এক ধরনের খেলা। এক সময় আপামনি ও দেশের বাইরে চলে গেলেন।

 

 

 

আমার আম্মার ও বাগান প্রীতি ছিল। তবে সেটা শাঁক সব্জি আর নানা রকম মরিচেই সীমাবদ্ধ ছিল। আপামণি প্রবাসী হওয়ার পর থেকেই দেখলাম ফুল গাছের প্রতিও আম্মার আগ্রহ জন্মেছে। আপামণির লাগানো গাছ গুলোকে বিশেষ যত্ন করতেন। মনে হয় ওগুলোর মধ্যে আপামণির ছোঁয়া অনুভব করতেন। একই সাথে কোথাও গেলে নতুন কোনো সুন্দর ফুলের গাছ দেখলে বাসায় এনে যত্ন করে লাগাতেন, নিয়মিত পরিচর্যাও করতেন।। আর তখন থেকেই আমার ও পালা শুরু। পরিচিত ও বন্ধুদের বাসা, স্কুলের বাগান, ঝোপ জঙ্গল থেকে জানা অজানা যাই দৃষ্টি কাঁড়তো নিয়ে আসতাম আমাদের বাগানের জন্য। এভাবেই সংগ্রহ আর আগ্রহ দুটোই দিনদিন বাড়তে লাগলো। স্কুলের সহপাঠিরা ঠাট্টা করে উদ্ভিদ বিজ্ঞানী বলতো। কারন আমি মাঠের ঘাসের মধ্যেও বাহারী গাছ আছে কিনা,তা খুঁজে বেড়াতাম। একটু সুন্দর আগাছা দেখলেও তা তুলে আনতাম, বারান্দার টবে লাগানোর জন্যে।একবার শীতে চাচা এক মালি কে এনে বাগানে অনেক ডালিয়া লাগালেন। ফুল ও হলো প্রচুর। কিন্তু মন কেন জানি ভরলো না। মনে হলো ,নিজেতো লাগাইনি। এর পর থেকে নিজেই লাগাতাম। ফুল কম হলেও মনে খুশি লাগতো নিজের হাতে ফুটানো ফুল দেখে। এখন পেশাগত কারণে সময় কম পাই। নিজের হাতে পুরোটা আর করা হয়না। তারপরও প্রতিবার শীতে নার্সারি থেকে চারা কিনে সাহায্যকারী নুর ভাই কে সাথে নিয়ে মৌসুমী ফুল লাগাই। ফুল দেখে আনন্দ লাগে। ছবি তুলে ফেইসবুকে সবার সাথে শেয়ার করি। তবে মনের মধ্যে একটু চিনচিনে ব্যথা থাকে, পুরোটা নিজে করতে পারিনি বলে। শীত চলে গেলেও সারা বছর জুড়ে নানা রঙের দেশি -বিদেশি ফুল ফুটে।আমাদের বাগানে ফুলের ফোঁটার পাশাপাশি চড়ুই, দোয়েল ফিঙে আর কাঠ ঠোকরার আনাগোনা চলে। এখন জলজ ফুল, নানা রঙের শাপলা,স্বর্ণকুমুদ, জল গোলাপ ও যোগ হয়েছে সংগ্রহে।

 

 

 

আমার আরেকটি আগ্রহের জায়গা হচ্ছে অর্কিড। সেই ছোটবেলায় আমগাছে,অযত্নে বেড়ে উঠা, ঝুঁলে থাকা অদ্ভুত সুন্দর ,সাদা আর বেগুনি রং মেশানো ফুল গুলো দেখে মনে হতো ,এতো সুন্দর ফুল ,কেন এর এতো অনাদর। সিলেটে এগুলো “ঝগড়া ফুল”নামে পরিচিত। বায়োলজি পড়ে জানলাম,এর নাম রাস্না,এক ধরনের অর্কিড। সেই থেকেই অর্কিড প্রেমের শুরু। বাসার আমগাছ থেকে নামিয়ে বারান্দায় ঝুলালাম। নিজের হাতের নাগালে, দৃষ্টির কাছাকাছি নিয়ে আসলাম। দিনে রাতে অপেক্ষায় থাকতাম,কবে ফুল ফুটবে। কিন্তু সেতো বছরে মাত্র একবার ফুটে। তাতেও অনির্বচনীয় আনন্দ। ধীরে ধীরে সিলেটের স্থানীয় অর্কিড এর সংগ্রহ বাড়ালাম বিভিন্ন জায়গার বড় গাছগুলো থেকে একটা দুইটা এনে এনে। ইতিমধ্যে বিদেশি হাইব্রিড অর্কিড ও আসতে শুরু করলো সিলেটের দু একটা নার্সারিতে।আমিও তখন রোজগেরে। কিছুটা বেশি দাম হলেও একটা দুটো করে কেনা শুরু করি। গাছ নিয়ে এসে আম্মাকে দাম টা বলা এড়িয়ে যেতাম। বাজে খরচ বলে বকা দিবেন,সেই ভয়ে। কিন্তু শখ বলেতো একটা শব্দ অভিধানে আছেই। চলছিলো এভাবেই ঢিমেতালে। কালে ভদ্রে এক দুইটা ফুল ফুটতো।একসময় কথা হলো শ্রদ্ধেয় শিরিন চৌধুরী আপার সাথে। তার ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে আপার সভাপতিত্বে গুটি পাঁচ-ছয় সদস্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলো সিলেট অর্কিড সোসাইটি। নিমগ্ন হলাম গভীর অর্কিড প্রীতিতে। আপারই পরামর্শে লন্ডনে বসবাসরত আপামনি কে দিয়ে আনালাম অল পারপাস মিরাকল গ্রো পাউডার। অর্কিড এ প্রয়োগ করার কিছুদিনের মধ্যেই ভালো ফলাফল পেলাম। এখন ফুল ফুটে সারা বছর জুড়েই। সংগ্রহ ও আল্লাহর রহমতে বেড়েছে অনেক।দেশে এবং দেশের বাইরে থাকা আমার ভাই,বোন,বোনের মেয়ে সবাই ঝুঁকি নিয়ে নানা ভাবে আমার অর্কিড রাজ্যকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করেছে।এ ভাবেই চলছিল।

 

 

 

 

যখন ফেইসবুক এ অমরাবতিতে আমন্ত্রণ পেলাম শেবুল মামার মাধ্যমে, মনে হলো যেন সত্যিই একটা ঠিকানা পেলাম নিজের ভাল লাগাগুলো আরো অনেকের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়ার। কারণ ভাল লাগাটা কারো সাথে ভাগাভাগি করে নিলে মনে হয় তা যেন আরো বহু।গুনে বেড়ে যায়। শুরু হল অমরাবতির পাতায় আমার বিচরণ। কাজের ফাঁকে ফাঁকে, সকাল, দুপুর, বিকেল, রাতে, যখন তখন, নিজের বাগানে ফোঁটা ফুল পাতা আর প্রকৃতির দৃষ্টি নন্দন ছবি তুলে, উড়িয়ে দিতে থাকলাম অমরাবতির পাতায়।

 

 

 

এক সময় অমরাবতি সংযুক্ত হলো পরিবেশ রক্ষার কাজে। শুরু হলো অমরাবতির বৃক্ষ রোপন অভিযান। নিজেকে এই বৃক্ষ রোপন কার্যক্রম এ সক্রিয় ভাবে যুক্ত করতে পেরে অনির্বচনীয় আনন্দ অনুভব করলাম। সাথী করে নিলাম আরো কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকেও। মনে হল যেন প্রকৃতির প্রতি ভালবাসার পরিপূর্ণতার পথে পা বাড়ালাম। অফুরান ধন্যবাদ শেবুল মামাকে, আমায় অমরাবতি তে সংযুক্ত করার জন্যে।ইতিমধ্যে অমরাবতির বোর্ড থেকে আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হলো বৃক্ষ রোপন কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য।আমরা সিলেট চাপ্টারের সবাই কর্মসূচী বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন জায়গায় বৃক্ষ রোপন অব্যাহত রাখি।সেই সাথে প্রত্যাশা করি সফল হোক অমরাবতির বৃক্ষ রোপন অভিযান। সবুজের সমারোহে ভরে থাকুক আমাদের প্রিয় ধরিত্রী। সফলতায় পরিপূর্ণ থাকুক অমরাবতির পথচলা। ইতিমধ্যে শেবুল মামা , সুলতানা খালা (লন্ডনের ),সহ অমরাবতির বোর্ড অফ ডাইরেক্টরস থেকে সিলেট চাপ্টারের WhatsApp গ্রুপ ওপেনের তাগিদ আসলে সিলেট চাপ্টারের পক্ষ থেকে আমরা ওপেন করে অনেক বিশিষ্ট জনদের ইনভাইট করি।ইতিমধ্যে বিশিষ্ট চিকিৎসক,মুক্তিযুদ্ধা ডাক্তার জিয়া উদ্দিন ভাই,বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট নজরুল ইসলাম বাসনভাই, কর্ণেল সালাম ভাই সহ আরো অনেক বিশিষ্ট জনেরা আমাদের ডাকে সারা দিয়ে অমরাবতির ক্যাফেলায় যুক্ত হয়েছেন।আমার বিশ্বাস আমরা সবাই মিলে সবুজের সমারোহ গড়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবো।

 

 

 

 

পরিশেষে আমার বাগানের কথা দিয়ে শেষ করতে হয় তাহলে বলবো আনন্দের সময় ফোঁটা ফুল গুলোকে দেখলে আনন্দ টা দ্বিগুণ হয়ে যায়। তেমনি দুঃখের সময়ে তারা( ফুল) দুঃখ টাকে অর্ধেক করে দেয়, মনে প্রশান্তির প্রলেপ লাগায়। এভাবেই ফুল -পাখি, গাছপালা , অর্কিড, অমরাবতি আর সুখ দুঃখ নিয়ে বয়ে চলে জীবন নিরন্তর।

ডাঃ খুর্শেদা তাহমীন শিমু ,
সিলেট।