অমরাবতির গল্প-(৩২)—-মোঃ শেবুল চৌধুরী

প্রকাশিত: ৮:১৭ অপরাহ্ণ, জুন ৯, ২০২৩ | আপডেট: ৮:১৭:অপরাহ্ণ, জুন ৯, ২০২৩

 

 

 

‘অমরাবতি’ আজ একটি পরিবেশবাদী সংগঠন হিসেবে কাজ করে যাবার দৃঢ় প্রত্যাশী। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পেশার বিশিষ্টজনেরা অমরাবতির ক্যাফেলায়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ তথা বিশেষ করে সবুজ সিলেট কিংবা সুন্দর সিলেট দেখতে যে কয়েকজন সিলেটের সাংবাদিক ও কলামিস্ট সুদীর্ঘ ৪০ বছর যাবৎ কলম যুদ্ধসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছেন, যিনি শুধুমাত্র সাংবাদিক নয় একজন মানবিক মানুষ, যাঁর ক্ষুরধার লিখনিতে বেরিয়ে আসছে সিলেটের উন্নয়ন ও মানুষের সম্পদ রক্ষার কথা। তাঁদের মধ্যে অন্যতম অমরাবতিয়ান হচ্ছেন, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট নজরুল ইসলাম বাসন ভাই। আসুন জেনে নেই কী রয়েছে বাসন ভাইয়ের লিখায়ঃ

 

 

 

তখন ষাটের দশক। আমাদের বাসা ছিল সিলেটের কীন ব্রীজের খুব কাছেই সুরমা নদীর একেবারে পার ঘেষে।তখন সুরমা পারে কদম গাছের ছড়াছড়ি, আরো কত নানা রঙের বনফুল ও লতাগুল্ম ছিল।পরিবেশটা ছিল খুবই মনোরম। এর সাথে ছিল উৎসব। আমার শৈশবের এক অমলিন স্মৃতি,বর্ষায় সুরমা নদীতে নৌকা বাইচ।শৈশবের স্মৃতিতে এখনও যে চিত্র জাগরুক তাহলো সিলেটে ছিল সবুজের সমারোহ, হারিয়ে যাওয়া সবুজের সমারোহ নিয়েই আমার আজকের এই লেখা।

আমার বাবা জেলা প্রশাসকের অফিসে চাকুরী করতেন।সরকারী কর্মকর্তা , রবিবার ছিল তাঁর সাপ্তাহিক ছুটি দিন। ছুটির দিনে বাবা বাসার সামনের জায়গাটায় সব্জির বাগানে কাজ করতেন, শিশু আমি ছিলাম বাবার সহকারী। বাবার সহকারী হিসেবে সেই সময় থেকেই গাছ পালা আমার শিশু মনে শিকড় গেড়ে বসেছিল। যখন একটু বড় হলাম তখন আমরা শেখ ঘাটে আমাদের নিজস্ব বাসায় চলে এসেছি, তখন ও মধ্য ষাটের দশক। সিলেট সরকারী পাইলট স্কুলে পড়তাম, স্কুলে যাওয়া আসার পথে একটি ছোট পার্ক ছিল। সেখানে নানা ধরনের ফুলের গাছ ছিল। বকুল ফুলের গাছ ছিল ডিসির বাংলোর ফুটপাতে,এখন যে জায়গাটা জেলা পরিষদ হয়েছে এখানটায় ছিল পার্ক। ডিসির অফিসের সামনে ও হাসান মার্কেটের সামনের পেট্রোল পাম্পে ছিল শেকল দিয়ে বেড়া দেওয়া আর ভিতরে ছিল ফুলের গাছ ও সুন্দর সুন্দর সুন্দর ফুলের কচু গাছ।সিলেটের বাসা বাড়ীতে জুই, চামেলী,চন্দ্র মল্লিকা, টগর, গন্ধরাজ, পাতাবাহার ও রঙীন কচুর গাছ ছিল প্রচুর। পাতাবাহারের গাছ দেখা গেলেও রঙীন ফোটা মাখা কঁচুর গাছের সংখ্যা এখন কমে গেছে।

 

 

 

আমরা যে সময় বড় হয়েছি তখন সিলেট শহরের বেশ কিছু বাসা বাড়ীর আঙ্গিনায় ফুলের বাগান থাকত ।গোলাপ,গাদা (গেন্ধা), বেলি,কামিনী সহ বিভিন্ন জাতের ফুল গাছের সমাহার ছিল। আম, জাম, সুপারি ছাড়াও নারিকেল গাছ থাকতো, যাদের বাড়ীর আঙ্গিনা ছিল বড়।আমার বয়সের অনেকের শখের বাগান ছিল, তবে আমার ও শখের বাগান ছিল। আমি আমাদের বাসার ছাদের উপর লাল ও হলুদ রঙের ডালিয়া ও গাদা (গেন্ধা) ফুলের গাছ লাগাতাম। আমাদের শেখ ঘাটের বাসা রাস্তার পাশে হওয়ায় পথচারীরা ফুল ফুটলে তা দেখতে পেতেন। আব্বা আমাদের বাসার সামনে সুপারি ও পেয়ারা গাছ লাগিয়েছিলেন।একটি লেবইর গাছ ও ছিল। পুরোনো বাড়ী ভেঙ্গে নতুন বাড়ী নির্মাণ করার সময় দুটো নারিকেল গাছ,সুপারি গাছ সহ সব গাছ কেটে ফেলা হল।শুধু আমাদের বাসা নয়, পুরো শহরে বহুতল ভবন ও মার্কেট নির্মাণ করার ফলে উন্মুক্ত প্রাঙ্গনের সংখ্যা কমে গেছে।এখন সারা সিলেট নগর হয়ে গেছে কংকিটের বস্তি।বহুতল ভবন মার্কেট নির্মাণে সিটি কর্পোরেশন যদি নিয়ন্ত্রণ না আনে তাহলে সিলেট নগরীর পরিবেশ আরো ক্ষতির সম্মুখীন হতে বাধ্য।এবার আসি আমার ব্যক্তিগত প্রশংগে। আমি সিলেটের জাফলং চা বাগানে এসিসটেন্ট ম্যানেজার হিসাবে চাকুরী নেই ১৯৮৩ সালে। জাফলং চা বাগানে গিয়ে দেখলাম আমার সামনে অবারিত মাঠ,গগন ললাট।চুমে তব পদধূলি।সবুজের সমারোহে চা গাছের সাথে আমার কেমন যেমন একটা সখ্যতা গড়ে উঠলো। বাংলোর বাগানের গাছ গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে দেখলাম কিছু আন কমন গাছ এবং আন কমন ফুল গাছ। এক বৃদ্ধ চা শ্রমিকের কাছে প্রশ্ন করে জানলাম এগুলো ইংরেজ সাহেররা এক সময় লন্ডন থেকে এনে বিভিন্ন বাগানে লাগিয়েছিলেন, জাফলংয়ে ও কিছু গাছ আনা হয়েছিল। ম্যানেজার ও এসিসটেন্ট ম্যানেজারের বাংলোর বাগানে দেশীয় গোলাপ, চামেলি,মাধবী, বাগান বিলাস,টগর, শেফালী ফুলের পাশে দুষ্প্রাপ্য এসব গাছ ও ছিল।

বয়স্কদের মনে থাকতে পারে সিলেটের হাইওয়ে গুলোতে সারি সারি জারুল গাছ ছিল, এ সব বৃক্ষরাজি ছিল যেমন দৃষ্টি নন্দন, তেমনি এই গাছগুলোর প্রয়োজনীয়তা ছিল। বন্যার পানির তোড় থেকে রাস্তার দুধারকে রক্ষা করতে এই গাছগুলো লাগানো হত। কিন্ত রাস্তা বড় করার সময় অর্বাচীন পরিকল্পক দের হাতে এই গাছ গুলো নির্মম ভাবে অপসারিত হয়েছে। ইংরেজ আমল বলেন আর পাকিস্তানী আমল বলেন, তখন রাস্তার দু’ধারে জারুল গাছ ছিল। বৃটিশ আমলে পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রচুর গাছ তারা লাগিয়েছিল।সিলেটের চা বাগানগুলো তাদেঁর হাতেই সৃষ্টি।এখনকার চা বাগানের মালিক ও ম্যানেজমেন্ট কতৃপক্ষ গাছ লাগানো তো দূরের কথা, যা ছিল তাও কেটে ফেলে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে।যার ফলে পরিবেশের উপর এর প্রভাব পড়েছে মারাত্মক ভাবে। যদি সিলেট সিটির কথাই ধরা যায় তাহলে দেখা যাবে পুরো শহরটাই অগোছালো ও অপরিকল্পিত। এই সমস্ত অপরিকল্পিত ভবন,শপিং সেন্টার, সরকারী অফিস আদালত নির্মাণ করায় পুরো শহরটার আদলই বদলে গেছে। নগর পরিকল্পনা করীরা সিলেট শহরের আদি সৌন্দর্য বজায় রাখার জন্য যা করতে পারেন তাহলো সার্কিট হাউস, ডাক বাংলা, ডিসির বাংলা , জর্জ কোর্ট, ডিসির অফিস, এসপির অফিস, রেজেষ্টারী অফিস শহরের বাহিরে নিয়ে যেতে হবে। শহর তলীর আলম পুরে সরমা নদীর পারে বিভাগীয় কমিশনারের অফিস, ডি,আই,জির অফিস, পাসপোর্ট অফিস, দক্ষিণ সুরমা স্কুল ইত্যাদি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখনও সিলেট শহরের ভেতরে থাকা সার্কিট হাউস, ডাক বাংলা, ডিসির বাংলা, জর্জ কোর্ট, ডিবির অফিস, এসপি’র অফিস, রেজেষ্টারী অফিস ইত্যাদি যদি আলমপুরে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে সিলেট শহরের যানজট হ্রাস পাবে।পরিত্যক্ত এই স্থাপনা গুলোকে স্কুল, কলেজে রুপান্তরিত করা যেতে পারে।পরিত্যক্ত জেলের প্রচুর জায়গা আছে,এইসব জায়গা সবুজায়ন করা উচিত।ভূমি খেকোদের হাত থেকে জেলের ভূমি রক্ষা করার জন্য, ঐতিহাসিক জেলকে মিউজিয়ামে রূপান্তর করা এখন সময়ের দাবী।

প্রয়াত সর্বজনাব এম সাইফুর রহমান, হুমায়ুন রশীদ চৌধূরী,আবুল মাল আবুল মুহিত আজ বেঁচে নেই কিন্তু তাদেঁর স্বপ্নের সিলেট শহর আজও বেচে আছে এবং বেচে থাকবে যতদিন পৃথিবী থাকবে। তাদেঁর স্বপ্নের সিলেট শহরকে সুন্দর করে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এখনই সুরমা নদী খনন করা দরকার, প্রাক্তন জেলা কারাগারে সবুজায়ন করা দরকার, কারাগারের ভবন গুলো রক্ষা করার জন্য যাদুঘর করা দরকার। দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য একটি মিউজিয়াম এই কারাগারে করা হলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মানুষ জানবে তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য । শেষ করার আগে বলতে চাই শৈশব থেকে যে সবুজ সিলেট শহর আমরা দেখে এসেছি দেখে দেখে বড় হয়েছি,সেই সিলেট নগর এখন কংক্রিটের বস্তি।এই বস্তির ভিতর থেকে বৃক্ষ প্রেমিক কিছু মানুষ ‘অমরাবতি’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন।
কংক্রিটের নগরে তারা পাথরে ফুল ফাটানোর বাসনা নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বৃক্ষ রোপন চালিয়ে যাচ্ছেন। শহীদ স্মৃতিউদ্যান এবং বিদেশী এনজিও প্রতিষ্ঠানেও ইতিমধ্যে তারা বৃক্ষ রোপন করে এসেছেন। অমরাবতির প্রাণ বার্মিংহামের শেবুল চৌধুরী,রাশিয়া খাতুন, লন্ডনের সুলতানা রহমান, খালেদা রওশন, রেহানা খানম রহমান, অতি সম্প্রতি আমি (নজরুল ইসলাম বাসন) ,সিলেটের ডাক্তার খূর্শিদা তাহমিন শিমু,শিরিন চৌধূরী,আহমেদ জিন্নুন দারা,এ এস জায়গীরদার বাবলা সহ দেশ বিদেশ থেকে আরো বৃক্ষ প্রেমিক যোগ দিয়েছেন তন্মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার জিয়াউদ্দিন আহমেদ, কর্ণেল সালাম, রাশেদা কে চৌধূরী সহ অনেক বিশিষ্ট জনেরা।তাদেঁর মিলিত প্রাণের প্রচেষ্টায় সিলেট আবারো তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে,এই প্রত্যাশা রাখা যায়।