এখনও বন্যার ক্ষতচিহ্ন সিলেটের সড়কে সড়কে

প্রকাশিত: ৬:৫৬ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৪, ২০২৩ | আপডেট: ৬:৫৬:অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৪, ২০২৩

জাহাঙ্গীর আলম খায়ের, সিলেট

২০২২ সালের জুন মাসে ভয়াবহ বন্যায় ‘ঢাকা-সিলেট’ মহাসাড়কসহ সিলেট সদর, বিশ^নাথ, ওসমানীনগর ও বালাগঞ্জ উপজেলার এলজিইডি ও সওজের প্রায় ৫ শতাধিক সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরমধ্যে সিলেট সদরের ১০০টি, বিশ^নাথের ১৫২টি, ওসমানীনগরের ৮২টি, বালাগঞ্জের ৬৫টি এবং বাকি ১০১টি ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক সওজের আওতাধীন। বন্যা পরবর্তি সময়ে অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক চিহ্নিত করে সংস্কারের জন্য আবেদন করা হয়। কিন্তু বন্যার প্রায় দীর্ঘ দেড় বছরেও ক্ষতিগ্রস্ত ওই সড়ক গুলো সংস্কাওে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে, এখনও ষ্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে সিলেটের সড়কে সড়কে। ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন এবং প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। আবার কোন কোন এলাকায় সড়ক সংস্কারের নামে সরকারি বরাদ্দের টাকা আত্মসাৎ করারও অভিযোগ রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানাগেছে, গত বছরের ভয়াবহ বন্যায় বিশ^নাথের সবক’টি গ্রামীণ সড়কসহ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এলজিইডির প্রায় দেড় শতাধিক সড়ক। এতে প্রায় ৭০ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩৫টি সড়ক। আর প্রায় ৯৫ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এলজিইডির আওতাধীন বিশ^নাথের ‘কাদিপুর-লামারচক-বৈরাগীবাজার’ এবং নকিখালী-সিংগেরকাছ’ সড়কসহ প্রায় ১২৫ট সড়ক। আর ৯০ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয় সওজ সিলেটের আওতাধীন ‘রশিদপুর-বিশ^নাথ-রামপাশা-লামাকাজী’ ১৫ কিলোমিটার সড়ক। বন্যাপরবর্তি সময়ে অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণসড়ক মিলিয়ে ১০৫টি সড়ক চিহিৃত করেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর বিশ^নাথের (এলজিইডি) কর্মকর্তারা।

তারপর ওই সড়কগুলি দ্রুত সংস্কারের জন্য তালিকা তৈরি করে প্রায় ৩৫কোটি টাকার একটি প্রস্তবনা (সড়ক-মেরামত) বাজেট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠান তারা। কিন্তু ষ্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার প্রায় ১৪মাস পেরিয়ে গেলেও উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত জনগুরুত্বপুর্ন ওই ১০৫টি সড়ক সংস্কারে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। জনগুরুত্বপূর্ন ওই সড়কগুলি দ্রুত সংস্কারের দাবি এখন সর্বস্থরের মানুষের।

 

 

সরেজমিন সিলেটের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বন্যা পরবর্তি সময় থেকেই সড়কগুলির ভয়াবহ ক্ষতচিহ্নের উপর দিয়েই প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে চলছে লাখ লাখ যানবাহন। খানাখন্দে ভরপুর আর ছোটবড় গর্তগুলো দেখলে মনে হয়, সড়ক তো নয়, যেন ছোট-বড় পুকুর। এমন অবস্থায় ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করতে হচ্ছে ‘ঢাকা-সিলেট’ মহাসাড়কসহ সিলেট সদর, বিশ^নাথ, ওসমানীনগর ও বালাগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দাদের।

আর মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন সওজের আওতাধীন ‘রশিদপুর-বিশ^নাথ-রামাপাশা-লামাকাজী’ সড়ক দিয়েই কাদিপুরস্থ বিশ^নাথ উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সেও যেতে হচ্ছে চিকিৎসকসহ এই অঞ্চলের সহ¯্রাধিক জনসাধারণ ও অসুস্থ রোগীদের। ফলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পুরো উপজেলাবাসীকে। দুর্ভোগ লাঘবে পৌরসভার পক্ষ থেকে ‘রশিদপুর-বিশ^নাথ-লামাকাজী’ সড়কের দশদল পর্যন্ত ইটের খোয়া ফেলা হয়। কিন্তু তারপরও বেহাল ওই সড়ক।

অথচ, চলতি ২০২৩ সালের গত ১৩জুন বেহাল ‘রশিদপুর-বিশ^নাথ-রামপাশা-লামাকাজী’ সড়ক মেরনামতের জন্য কার্যাদেশ পায় ৮৩৫৪৩৯ নং আইডধারী ‘আবিদ-মনসুর-কনস্ট্রাকশন নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে নামমাত্র ইটের খোয়া ফেলে বরাদ্দের ২১লাখ ২৮হাজার ৩৯৬টাকা ভাগভাটোয়ারা করে নেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সিলেট সড়ক বিভাগের (সওজ) কর্মকর্তারা। তবে, সংস্কার নিয়ে নানা বিতর্ক আর অভিযোগ থাকলেও সম্প্রতি আবারও প্রায় ৯কোটি ৫৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ওই সড়ক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

 

 

 

বেহাল অবস্থায় রয়েছে ‘নকিখালী-সিংগেরকাছ’ আরএইচডি সড়কের পৌনে ১০কিলোমিটার, ‘রামপাশা-বৈরাগী বাজার’ আরএইচডি সড়কের ২কিলো ১০০মিটার, ‘বিশ^নাথ-টেংরা-লালা বাজার’ আরএইচডি সড়কের সাড়ে ৪কিলোমিটার, বিশ^নাথ-নতুনবাজার-কুরুয়া’ আরএইচডি সড়কের সোয়া ৬কিলোমিটার, ‘বিশ^নাথ কলেজ-নাজিরবাজার’ আরএইচডি সড়কের পৌনে ৪কিলোমিটারসহ প্রায় সবকটি সড়ক।

তার চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা ‘কাদিপুর-লামারচক-বৈরাগীবাজার’ সড়কের। গেল বন্যাকালীণ সময়ে লামারচকের ইশকার আলীর বাড়ির সামনের মোড়ের কালভার্টসহ প্রায় ২০০মিটারেরও বেশি পাকা সড়ক উপড়ে বানের পানিতে ভেসে গিয়ে বড় একটি খালে পরিনত হয়। ২০২২সালের ডিসেম্বরে সিএনজি চালক ও স্থানীয়রা মিলে মাটি দিয়ে ভরাট করে দিলে কিছুদিন যানবাহন চলাচল করে। এরপর ২০২৩ সালের মে মাস থেকে প্রায় ৬মাস ধরে ওই সড়ক দিয়ে যান চলাচলব বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে ওই মোড়ের খালে বাঁশ দিয়ে পারাপারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে স্থানীয় লোকজনকে মাছ শিকার করতেও দেখা গেছে।
পেশায় বাস চালক শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন কমপক্ষে ৪বার ‘বিশ^নাথ-রৈরাগী-সিংগেরকাছ’ সড়ক দিয়ে যাত্রী নিয়ে যান তিনি। এতে বিভিন্ন সময় ব্রেক ফেল হয় এবং গাড়ির ইঞ্জিনসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বিকল হয়। একই অভিযোগ সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের বাস চালক ইদ্রিস আলীর। তিনি বলেন প্রতিদিন সিলেট থেকে ওসমানীনগরের তাজপুর হয়ে বালাগঞ্জে বাস নিয়ে যান তিনি। এতে ভাঙাচোরা সড়কে গাড়িতে অনেক টাকার কাজ আসে।
সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক সিরাজ উদ্দিন, মখন মিয়া, ইনসান আলীরও একই দাবি। আর ইজিবাইক চালক হারিছ আলী বলেন, সারাদিনে ৩০০ টাকা ইনকাম হলেও রাস্তা ভাঙার কারণে গাড়িতে কাজ আসে ৩৫০টাকা। এতে লাভের জায়গায় আরও লোকসান গুনতে হয় তাকে।

ওসমানীনগরের গোয়ালাবাজরের ব্যবসায়ী ফারুক আহমদ, নজরুল ইসলাম, বিশ^নাথের শাহনুর হোসাইন, আবিদ আলী ও সমুজ আলী বলেন, বন্যার পর সংস্কার না হওয়ায় সড়কদিয়ে চলাচল করাই দায়। একবার যাতায়াত করলে পরদিন শরীরের ব্যাথায় আর বের হওয়ার ইচ্ছে থাকেনা।

এ প্রসঙ্গে বিশ^নাথ পৌরসভার মেয়র মুহিবুর রহমান বাংলাপকাগজকে বলেন, দীর্ঘদিন সংস্কার কাজ না হওয়ায় সড়কজুড়ে গর্ত আর খানাখন্দ। জনসাধারণের দুর্ভোগ লাঘবে পৌরসভার পক্ষ থেকে বিশ^নাথ পৌরশহর থেকে কাদিপুর পর্যন্ত ইট ফেলে গর্ত ভরাট করে তিনি দিয়েছেন। কিন্তু সওজ কর্তৃপক্ষ কবে কোথায়? সড়ক মেরামত করালেন, তা চোখে পড়েনি। সংস্কারের নামে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক এমপি আলহাজ¦ শফিকুর রহমান চৌধুরী বাংলাকাগজকে বলেন, সিলেটের রশিদপুর-বিশ^নাথ-লামাকাজী’ সড়ক সংস্কাওে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষে দোষিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে বিশ^নাথ উপজেলা প্রকৌশলী মো. আবু সাঈদ বাংলাকাজগজকে বলেন, বন্যার পর এলজিইডির আওতাধীন প্রায় ১০৫টি সড়ক চিহ্নিত করে দ্রুত সংস্কারের জন্য ৩৫ কোটি টাকার একটি প্রস্তাবনা বাজেটসহ সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে আবেদন পাঠান। পরবর্তিতে আর অগ্রগতির কোন সংবাদ তিনি পাননি। তিনি জানান, এভাবে ওসমানীনগর ও বালাগঞ্জের সড়কগুলো সংস্কারের জন্য তালিকা পাঠানো হয়। কিন্তু সিলেটের কোন উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক এখনও সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

ঠিাকাদির প্রতিষ্ঠান ‘আবিদ-মনসুর কনষ্ট্রাকশন’র কর্নধার আবিদ মনসুরকে মোবাইল ফোনে প্রায় ১৫দিন কল করা হলেও গত তিনি ফোনকল রিসিভ না করায় তার কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে, সিলেট সড়ক বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, ইটের খোয়া ফেলার বিষয়টি ছিলো ভিন্ন একটি ইস্যু। বর্তমানে ৯ কোটি ৫৭লাখ টাকা ব্যয়ে সিলেটের ‘রশিদপুর-বিশ^নাথ-রামপাশা-লামাকাজী’ সড়ক সংস্কার কাজ শুরু করা হচ্ছে। ত্রিপুরা কনষ্ট্রাকশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে আগামি ৬মাসের মধ্যে তা সম্পন্ন করা হবে। এভাবে সিলেট সড়ক বিভাগের সবকটি সড়ক ক্রমান্বয়ে সংস্কার করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।