
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও গণআন্দোলনের ঢেউ এখন রূপ নিতে যাচ্ছে একটি ঐতিহাসিক রাষ্ট্রিক চুক্তি ‘জুলাই সনদ’। কয়েক মাসব্যাপী জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নেতৃত্বে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের যে সংলাপ ও আলোচনার প্রক্রিয়া চলে এসেছে, তারই ফসল এই সনদ। রাজনৈতিক বিভক্তির দীর্ঘ ইতিহাসে এ এক বিরল মুহূর্ত, যেখানে রাষ্ট্রীয় সংস্কার নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ১৬৬টি প্রস্তাবে অভূতপূর্ব ঐকমত্য গড়ে তুলেছে।
সনদের লক্ষ্য ও দর্শন
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভাষায়, ‘জুলাই সনদ’ কেবল রাজনৈতিক দলিল নয়, এটি একটি ভবিষ্যতপ্রতিশ্রুত সামাজিক চুক্তি যার উদ্দেশ্য- রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক, বিকেন্দ্রীভূত ও জবাবদিহিমূলক কাঠামোয় পুনর্গঠন করা।
জাতীয় ঐক্যমত
কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এই প্রক্রিয়া ভবিষ্যতের জন্য এক নৈতিক ভিত্তির নির্মাণ। সনদ বাস্তবায়িত হলে, নতুন প্রজন্ম আমাদের সাহসিকতা মনে রাখবে।
যেসব ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐকমত্য
কমিশনের তথ্যমতে, নিম্নোক্ত বিষয়গুলোতে প্রায় সকল দলের ঐক্যমত রয়েছে:
* সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংস্কার: সংসদ সদস্যদের দলভিন্ন অবস্থান গ্রহণের স্বাধীনতা নিশ্চিত।
* রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা হ্রাস, বিশেষত সাধারণ ক্ষমা প্রদানে।
* তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার নীতিগত সম্মতি।
* সংসদীয় আসনসীমা নির্ধারণে নতুন কাঠামো।
* স্থায়ী কমিটিতে বিরোধী দলের নেতৃত্ব।
* প্রধান বিচারপতির নিয়োগ পদ্ধতির সংস্কার।
* বিভাগীয় উচ্চ আদালতের বেঞ্চ স্থাপন।
তবে প্রধানমন্ত্রী পদের দুই মেয়াদ বা ১০ বছর সীমাবদ্ধতা প্রস্তাবটি এখনো পূর্ণ রাজনৈতিক সমর্থন পায়নি।
বিভাজন রয়ে গেছে যেসব বিষয়ে
সংলাপে একাধিক স্পর্শকাতর ইস্যুতে এখনো মতানৈক্য বিদ্যমান:
* সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন।
* রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য।
* নারী সংসদ সদস্যদের সরাসরি ভোটে নির্বাচন।
* সংবিধানিক নিয়োগে স্বাধীন বোর্ড গঠন।
জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, শতভাগ ঐকমত্য কখনোই বাস্তবসম্মত নয়। তবে আমরা একটি সর্বজনগ্রাহ্য সনদ উপস্থাপন করতে পারব বলেই আশাবাদী।
সনদ বনাম ঘোষণাপত্র
বর্তমানে আলোচনায় রয়েছে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল:
১. ‘জুলাই সনদ’ সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে তৈরি একটি আইনি দলিল।
২. ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক দিকনির্দেশনা।
লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, ঘোষণাপত্রকে প্রতীক হিসেবে না রেখে, এটিকে ভবিষ্যতের রাষ্ট্র নির্মাণের রূপরেখা হিসেবে দেখতে হবে। না হলে এটি তিন জোটের ব্যর্থ রূপরেখার পুনরাবৃত্তি হয়ে যাবে।
রাজপথের বাস্তবতা
জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জুলাই সনদকে ঘিরে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, আমরা যে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলাম, তা এখনো চোখে পড়ছে না। ঘোষণাপত্র ও সনদের বিষয়েও তালবাহানা চলছে। ফ্যাসিবাদী ভয়ের সংস্কৃতি ভেঙে যারা রাজপথে নেমেছে, তারা কাউকে ভয় পায় না।
জুলাই: এক নতুন অভ্যুত্থানের প্রতীক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুর রহমান আকাশ বলেন, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান থেকেই শুরু হয়েছিল এই চেতনার বীজবপন। যদি এই সনদ সাংবিধানিক ভিত্তি পায়, তাহলে তা হতে পারে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের এক নতুন অধ্যায়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী, জুলাই মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত সনদ প্রকাশ করা হবে। তখনই বোঝা যাবে এটি কেবল রাজনৈতিক কাগজপত্র, না বাস্তব প্রতিফলনের এক সাহসী উদ্যোগ।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আবুল খায়ের বলেন, জুলাই সনদ এখন শুধু একটি রাজনৈতিক দলিল নয়, এটি দেশের ইতিহাসে গণআকাঙ্ক্ষার দলিল হয়ে উঠার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এটির বাস্তবায়ন নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, জনসম্পৃক্ততা এবং প্রজন্মের চাপ প্রয়োগের ওপর। জুলাই কি হবে গণতন্ত্রের নবজন্ম, নাকি আরেকটি ব্যর্থ আশার নাম? উত্তর দেবে সময়, আর সময়ের গতিপথ নির্ধারণ করবে আমাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও জনসচেতনতা।