অমরাবতির গল্প-(২১)-মোঃ শেবুল চৌধুরী

প্রকাশিত: ১১:৩৯ পূর্বাহ্ণ, মে ১৩, ২০২৩ | আপডেট: ১১:৩৯:পূর্বাহ্ণ, মে ১৩, ২০২৩

 

 

অমরাবতির গল্প মানে সৌখিন বাগান বিলাসীদের গল্প। বৃক্ষ প্রেমিকদের গল্প। মালী, কৃষকদের গল্প। কৃষিতে এখন আর নেংটি পরা কৃষক নেই বরং বলা যায় কৃষি এখন জিন্স প্যান্ট পরা আধুনিক কৃষকদের হাতে।এই আধুনিক কৃষকরাই হচ্ছে অমরাবতির প্রাণ। এ রকম একজন অমরাবতিয়ান হচ্ছেন মোঃ কামরুজ্জামান বাবু।যিনি ‘জিন্স পরা কৃষক’ হতে চান। আসুন জেনে নেই কি আছে জিন্স পরা কৃষকের গল্পে।

 

 

 

আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা সিলেট শহরের আম্বরখানা এলাকায়। আমার বাবা প্রথমে ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা এবং পরবর্তী কালে শিক্ষকতা কে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। পেশাগত কারণে আব্বা বিভিন্ন জায়গায় যেতেন।ছুটির সময় বাসায় যখন আসতেন তখন মৌসুমী ফল নিয়ে আসতেন এবং সেই সাথে যেখানে যে ফল খেতেন এবং তা যদি ভালো মানের হতো ,তার বীজ নিয়ে আসতেন এবং তা আমাদের বসত বাড়ীতে রোপণ করতেন। প্রায় সকল ধরনের দেশীয় ফলের গাছ আমাদের বাসায় ছিলো।আব্বা ফল গাছ বেশী লাগাতেন। সব চাইতে মজার ছিলো ,একবার আব্বা একটা কাজুবাদামের গাছ নিয়ে আসলেন ।প্রচুর কাজুবাদাম ধরলো , কিনতু সেটা কিভাবে প্রসেস করে খেতে হয় তা আমরা কেউ জানতাম না। বাদামের রসালো অংশটি থেকে একধরনের পাঁকা ফলের মিষ্টি গন্ধ আসতো। যা অনেক পাকা কাঠালের গন্ধের মতো।

 

 

এত মিষ্টি গন্ধ, যে কেউ খেতে লোভ করবে।একবার এই রসালো অংশটিকে খাওয়া যায় মনে করে খেতে গিয়ে আমাদের ভাই বোনদের ঠোঁটে ইনফেকশন হলো। পরে অবশ্য সামনের অংশের বাদামটিকে অনেকক্ষণ সেদ্ধ করে ছুরি দিয়ে কেটে ভেতরের অংশটি খাওয়ার একটা পদ্ধতি আমরা বের করেছিলাম। আব্বার ফুলের প্রতি ও খুব আকর্ষণ ছিলো। ক্রিসেনকিমাম, ডালিয়া, সূর্যমূখি, জিনিয়া, কসমস, গাদা, গোলাপ, হাসনাহেনা, বকুল, জুই,বেলি, প্রায় সব ধরণের ফুলই আব্বা লাগাতেন। সবথেকে সুন্দর ছিলো বিশাল এক কৃষ্ণচুড়া গাছ। লাল কৃষ্ণচূড়া যখন গাছভর্তি হয়ে ফুটতো তা ছিলো এক অপার্থিব দৃশ্য।

 

 

 

আমাদের বাসার পাশেই নৃ ত্বাত্তিক জনগোষ্ঠী মনিপুরী সম্প্রদায়ের একটি জনবসতি ছিলো, তারা তাদের সকালের পুজোর ফুল গুলো আমাদের বাসা থেকেই নিয়ে যেতো। বাবা নেই আজ প্রায় ৩৫ বছর, আমরা একটার পর একটা দালান বানিয়েছি, আর বাবার লাগানো গাছগুলোকে একে একে হত্যা করেছি। এখন শুধু একটা বেল গাছ ও দুইটা কাঁঠাল গাছ বেঁচে আছে এবং এখন পর্যন্ত আমাদের ফল দিয়ে যাচ্ছে।

 

 

 

 

 

 

 

যাই হোক, এবার আসি আমার কথায়, আমি জেনেটিকেলি বাবার ঐ বৃক্ষ প্রেমটা পেয়েছি। যেহেতু বাসায় ভূমি তেমন নেই, তাই আমি বাসার ছাদকেই কৃষির জন্য বেছে নিয়েছি। প্রায় ১৫ বছর আমি বাসার ছাদে বিভিন্ন প্রকার সবজি ও সালাদ এর আইটেম গুলো চাষ করতাম। নিজের পরিবারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি প্রতিবেশিদের ও দিতাম। আমার চিন্তার পরিবর্তন হয় ২০১৬ সালে। আমি শাক সবজি বাদ দিয়ে ছাদে ফল বাগান করতে মনোনিবেশ করি।

 

 

 

 

 

পেয়ারা, আম, সফেদা, জামরুল, আতাফল, শরীফা, মাল্টা, লেবু এগুলো লাগানো শুরু করি। কিন্তু প্রতিটি ফলের মেইনটেইনিং পদ্ধতি আলাদা আলাদা হওয়ায় অচিরেই আমি ফল বাগানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। ২০১৮ সালে আমি ইউটিউবে শাইখ সিরাজ সাহেবের একটি পোগ্রাম দেখি, যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ডিগ্রিধারি এক মহিলা ঢাকার সাভার এলাকায় ৫০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে ড্রাগন ফলের এক বিশাল বানিজ্যিক বাগান করেছেন। ড্রাগন ফল তখন ঢাকার কয়েকটি সুপারস্টোর এ পাওয়া যেতো, মূল্য ছিলো প্রায় ১০০০/১২০০ টাকা কেজি। আমি তখন কৃষির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিয়ে পড়াশুনা শুরু করি। নাটোর জেলার এক কৃষি কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করি এবং ৫০০/- টাকা পিছ দরে ৩০ টি চাঁরা কিনে আনি।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বাসার ছাদে সিমেন্ট এর রিংগে তা প্রতিস্হাপন করি এবং ১৮ মাস যত্ন করার পর প্রথমবারের মতো আমার ড্রাগন ফল গাছে ফল আসে। আমি ততদিনে ড্রাগন এর চারা উৎপাদন পদ্ধতি শিখে ফেলি এবং নিজেই চারা উৎপাদন করতে থাকি। গত চার বছরে আমার ছাদবাগানে আমি ড্রাগন ফল এর ৫ টি ভ্যারাইটির সমাবেশ করেছি। প্রথম থেকেই অমরাবতীর অনেক সদস্য আমার ছাদ বাগানে এসে ড্রাগন ফলের স্বাদ নিয়েছেন এবং অনেকে চাঁরাও নিয়েছেন। এখন আমার স্বপ্ন বিবিধ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এই ড্রাগন ফলের একটি বাণিজ্যিক খামার প্রতিষ্টা করার। কিছুটা কাজ এগিয়েও নিয়েছি। আশা করছি অচিরেই জিন্স ও টি শার্ট পরা এক উচ্চশিক্ষিত স্বপ্নবাজ অমরাবতীর সদস্য কৃষক কে সিলেটবাসি দেখতে পাবে। আমার জন্য দোয়া করবেন।।