অমরাবতির গল্প-(২২)——মোঃ শেবুল চৌধুরী

প্রকাশিত: ৩:১১ অপরাহ্ণ, মে ১৫, ২০২৩ | আপডেট: ৩:১১:অপরাহ্ণ, মে ১৫, ২০২৩

অমরাবতির গল্প মানেই পরিবারের গল্প, সবুজের গল্প। একটি গাছ,একটি প্রাণ,এই কথাটা শুধু পোস্টারে নয়,কেউ কেউ মনে প্রানে বিশ্বাস করে নিরবে প্রকৃতির জন্য কাজ করে গেছেন যুগ যুগ ধরে। গাছ লাগানোর উপযোগিতা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারিবারিক পরিমন্ডল তথা বিশেষ করে ছেলে মেয়েদেরকে, অনেকেই নিরলস ভাবে এ দীক্ষা দিয়ে গেছেন। এ রকম একজন পিতার অনুকরণে সবুজায়নের প্রতি আকর্ষিত হয়ে বাগান ,গাছ গাছালীর প্রেমে নিজেকে নিমজ্জিত রেখেছেন অমরাবতির অন্যতম সদস্যা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ দিলরুবা মুনমুন। আসুন জেনে নেই কি রয়েছে দিলরুবা মুনমুন এর অমরাবতির গল্পে।

 

 

 

গল্পের শুরু ছোটবেলা থেকে। ঐ সময় আমাদের দাদার বাড়িতে উঠানের একপাশে বিশাল এক পেয়ারা গাছ ছিল । দেখতে কি যে দারুন লাগত। আমরা প্রায়ই এই পেয়ারা গাছের নিচে খেলাধুলা করতাম।আর ঘরের দুই পাশে উঠানের সাইটে ছিল ডালিম আর আতা ফলের গাছ । টকটকে কমলা রঙ্গের ডালিম ফুল এত ভালো লাগত যে বলার মতো না।বাড়িতে প্রায় সব রকম ফলের গাছ ছিল।আমার দাদা ছিলেন বেশ আধুনিক মনের কৃষক। নিত্য নতুন ফসলের চাষ ছিল উনার বেশ শখের বিষয়।একবার নাকি বন্যার পানিতে কোথা থেকে বেশ বড় কচুর ঝাড় ভেসে এসেছিল। দাদা সেটা তুলে রেখেছিলেন আর পরে সেই কচুর বেশ সফল চাষ করে সারা গ্রামে বিলিয়ে ছিলেন । ওই কঁচুর মুখীর স্বাদ নাকি এতো মজা ছিল যে, সবাই পরবর্তীতে এর ব্যাপক চাষ করেন।উনারা অবশ্য ছিলেন জাত কৃষক।

 

 

 

 

 

 

 

 

আব্বা ছোট বেলায় পড়ালেখা পাশাপাশি কৃষি কাজ করতেন।পড়ালেখা শেষ হলে কিছুদিন চাকরির সুবাদে পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরেছেন।তিনি যেখানেই যেতেন না কেন তাঁর(আব্বার) আগ্রহ ছিল সেই দেশের কৃষি।তারা কি কি ফসল ফলায় কিভাবে ফলায় এগুলোর উপর দীক্ষা নিতেন এবং পরবর্তীতে দেশে এসে এগুলো নিজের জমিতে এক্সপেরিমেন্ট করতেন ।এতে কোনটা সফল হতো আবার কোনটা হতো বিফল। তবে নিয়ে আব্বার কখনো কোন আক্ষেপ ছিল না।আব্বা বি.এ.ডি.সি ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন সেই সুবাদে আমরা অনেকদিন সিলেট এর গোয়াইনঘাট উপজেলা কমপ্লেক্স এ ছিলাম। কমপ্লেক্সের প্রতিটা বাসার সামনে ছোট ছোট এক এক টুকরো জমি ছিল। শীতের আগমনে সেই জমি ঘিরে প্রতিটা পরিবার ই বেশ চাষাবাসের প্রস্তুতি নিত।আমাদের তখন কাজ ছিল স্কুল থেকে এসে আব্বার সাথে জমিতে কাজ করা। প্রথমে জমি পরিস্কার করে কোদাল দিয়ে মাটি আলগা করা হতো , তারপর হাত দিয়ে বা মুগুর দিয়ে পিটিয়ে মাটির দলা ভেঙ্গে মাটি সমান করা হতো। এতপর বেড বানানো হতো।প্রতিটি বেডে আলাদা আলাদা সবজি কখনো টমেটো কখনো লালশাক আবার কখনো কখনো আরও বিভিন্নজাতের সব্জি চাষ করা হতো।এই সবজিগুলো কখনো একা খাওয়া হতো না ,পালা করে প্রায় সব প্রতিবেশীদের বাসায় পাঠানো হতো ।সবচেয়ে মজার এবং ভালো লাগার বিষয় হলো এই ভেবে যে,সবাই বলতো মর্তুজ সাহেবের বাসা থেকে সবার আগে (সিজনের প্রথম) সব্জি আসে,যার স্বাদ সব থেকে আলাদা।এ গুলোর জন্য আমরা আমাদের পিতাকে নিয়ে গর্ববোধ করতাম। প্রতিবেশীদের অনেকেই এই ক্ষেত করতেন, মানুষ রেখে কিন্তু আব্বা করতেন নিজের হাতে ।আমাদের সমবয়সী অন্যদের বাবারা যখন বাজার বা ক্লাবে ব্যস্ত ,আর তাদেঁর বাচ্চারা হয়তো খেলার মাঠে , তখন কিন্তু আমাদের বাসায় দৃশ্যপট ছিল সম্পুর্ন আলাদা । আমরা তখন আব্বার সাথে ক্ষেতে। বলতে গেলে কামলা খাটছি আর তখন আব্বার উপর ভয়াবহ রাগ লাগতো। রীতিমতো ভিলেন মনে হতো আব্বাকে।তখন কিন্তু গাছের বীজ বুনতে বুনতে আব্বা যে আমাদের ভেতরেও অনেক কিছুর বীজ বুনেছেন তা আজ উপলব্ধি করতে পারি।আরেকটা বিষয় ছিল আব্বার সাথে জার্নি করার ও আলাদা একটা শিক্ষনীয় অভিক্ষতা রয়েছে।আব্বার পোস্টিং যখন গোয়াইন ঘাটে ছিল, সেই সময় গোয়াইনঘাট থেকে সিলেট আসতে সময় লাগত প্রায় তিন ঘন্টা।আব্বা আমাদের সাথে নিয়ে আসতেন।আসার পথে দেখা যেতো রাস্তার দুইপাশে বিশাল হাওর।কত শত বুনো গাছ, বুনোফুল । আব্বা যাওয়ার সময় ফুল পাতা দেখিয়ে গাছ চিনিয়ে দিতেন, আর আসার সময় পরীক্ষা নিতেন। না পারলে কঠিন কঠিন বকাও খেতে হতো। এইভাবে আমাদের একটু একটু করে গাছপালার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আমার আব্বা। কাওফল, মাঠাং খুদিজাম, বেতেরগুটা এগুলো এখন কার বাচ্চারা চেনা তো দুরে থাক, আমাদের সময়ের অনেকেই এইগুলির নাম ই শুনেন নাই বলে জানাতেন।আব্বা আমাদের ভাইবোনদের এগুলো চিনিয়েছেন ,খাইয়েছেন।

 

 

 

 

 

 

একদিন আমাদের দাদার বাড়িতে আমগাছের মাঝে বেশ সুন্দর কিছু ফুল ঝুলে থাকতে দেখে পেড়ে নিয়ে আসলাম ঘরের ফুলদানিতে রাখব বলে । তখনও জানিনা এটা ছিল পেন্সিল অর্কিড।আব্বা অর্কিড হিসাবে ওই গাছের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।অর্কিড এর সাথে পরিচয় মূলতঃ ঐ সময় থেকে।সেই সময় হঠাৎ আব্বাকে একদিন আল্লাহ উনার কাছে নিয়ে গেলেন ভয়াবহ বাস্তবতার সাথে ( দোয়া করি মহান আল্লাহ যেন আমার আব্বাকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে রাখেন)।আব্বার আকস্মিক মৃত্যুর ফলে বেশ লড়াই করে চলতে হয়েছিল আমাদের বেশ কয়েকবছর।সেইসময় একদম মৌলিক প্রয়োজন ছাড়া বাকি সবকিছুই ছেড়ে দিতে হয়েছিল,একমাত্র আম্মার আচার বানানো ছাড়া।

আমার আম্মা একজন সৌখিন বাগানী ছিলেন।ফুল বাগান করতেন। সিজোনাল ফুল কিনে আনতেন নার্সারি থেকে। প্রচন্ড রকমের ছবি তোলার নেশা আম্মাকে সবসময়ই ফুলের বাগানের দিকে টানতো। টুকটাক বনসাই বানানো শুরু করেন ২০০৩/৪ সালের এর দিকে। একটা দুইটা করে বেশ কিছু সৌখিন গাছ হলো সেইসাথে শুরু হলো ছাদ বাগান করা। এরপর ২০০৭/৮ এ আমরা সিলেট এ শিফট করলাম । দুইবার বাসা বদলানোর ঝামেলায় বেশ কিছু গাছ নষ্ট হলো কিন্তু উৎসাহ দ্বিগুণ হলো । একটা দুইটা করে আমাদের বাগানে যোগ হলো ২৯ টা গোলাপ গাছ এবং ১৩/১৪ রকমের জবা। এর মাঝে আম্মার ডায়াবেটিস ধরা পরলো।এটা সেটা বেশ কিছু ঝামেলার কারনে বাগান হয়ে গেল আম্মার বেশ শান্তির একটা জায়গা। ডায়াবেটিস এর জন্য ডাক্তার এর পরামর্শ ছিল প্রতিদিন একঘন্টা করে হাঁটা কিন্তু সময় আর আলসেমির জন্য প্রায়ই সেটা হয়ে উঠত না।আমার আম্মা মূলতঃ একজন স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন। প্রায় প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে এক থেকে দেড় ঘন্টা বাগানে পানি দিতেন ।পাইপ না থাকায় টেপ থেকে পানি দিতে হতো খেয়াল করে দেখলাম এইজন্য উনার রুটিন হাঁটা প্রায় হয়ে যায়।আবার বিকেলে এসে মাটি এটা সেটা নিয়ে সময় বেশ ভালোই কাটে।

 

 

 

 

 

 

 

অর্কিড এর সাথে পরিচয় হয়ার পরে প্রায়ই খুঁজতাম কোন গাছে অর্কিড দেখা যায় কি না। পেলে প্রান ভরে দেখতাম কিন্তু তখনও একে বাসায় আনার সাহস পাইনি।এরপর সিলেট এ বৃক্ষ মেলায় অর্কিড দেখে তো মাথা খারাপ অবস্থা কিনেও নিলাম দুইটি বেশ মোটা বাজেটে। কিন্তু যত্নের তো কিছু জানিনা।এখন কি করা, অবশ্য আল্লাহ এর উত্তম ব্যাবস্থা করে রেখেছিলেন।২০১৬ সালে পরিচয় হলো শিরিন আন্টির সাথে,যিনি অর্কিড এর মহারথী।উনার কাছ থেকে প্রথম শিখলাম কিভাবে অর্কিড করতে হয়।ছোট্ট একটা ড্যান্সিং লেডি উপহার দিয়েছিলেন আমাকে আর একটু একটু করে কিভাবে কি করব তার শিক্ষা। রীতিমতো উনার লেজ হয়ে গেলাম আমি। বলা যায় অর্কিড এর প্রতি ভালোবাসা উনার ছোঁয়ার পরিনতি পেয়েছে।
একদিন জলি আপার বাসাত যেয়ে চোখ ছানাবড়া ;কি নাই উনার ভান্ডারে, যা দেখি তাই মনে হয় নিয়ে আসি।উনার সাথে মিশি বুঝেছি গাছের প্রতি টান কি জিনিস, গাছকে কিভা‌বে ভালোবাসতে হয় উনাকে না দেখলে অনুভব করা যাবে না।২০২১ সালে এই গাছ থাকার কারনে আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন কিন্তু বিভিন্ন ঝামেলায় আমার গোলাপের সংখ্যা প্রায় শুন্যের কোটায় নেমে আসে প্রায় অর্ধেক গাছ নষ্ট হয়ে যায়। কিছু গাছ দিয়ে দিতে হয়েছে।মন নষ্ট হয়েছে, মন খারাপ করে।তারপর ও ঘুরে বেড়িয়েছি আবার উৎসাহ নিয়ে ঘুরে দাড়িয়েছি, আবার গাছ সংগ্রহ করেছি ।

হাজার কষ্ট ভুলিয়ে দেয় যখন গাছে ফুলের দেখা মেলে আর গাছ ও এমন একটু যত্নে উজার করে ভালোবাসা বিলিয়ে দেয়।কারো কারো মন্তব্য থাকে শুধু ফুল খাওয়ার কিছু নাই ,তখন আম্মার কথা থাকে পেট ভরার জন্য তো তিন বেলাই খাই, মন ভরানোর জন্যও না হয় তো কিছু —–।।