অমরাবতির গল্প (১৮) – মোঃ শেবুল চৌধুরী

প্রকাশিত: ৭:০৭ অপরাহ্ণ, মে ৬, ২০২৩ | আপডেট: ৭:০৭:অপরাহ্ণ, মে ৬, ২০২৩

“অমরাবতি”র গল্প মানে বাগান বিলাসীদের গল্প; পরিবেশের গল্প। বাগান করা অনেকটা পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিক বহিঃপ্রকাশ স্বরপ।আজ আমরা অমরাবতির সিলেটের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক, বিশিষ্ট বৃক্ষ প্রেমিক, রত্নগর্ভা মা ,অর্কিড সোসাইটির সভাপতি মিসেস শিরীন চৌধুরীর সৌখিন বাগানের গল্প শুনবো,শুনবো অমরাবতির গল্প,শুনবো নিজ পরিবার ও পরিবেশের গল্প।

 

 

 

আমার আব্বা কর্নেল আজিজুর রেজা চৌধূরী ১৯৬৫ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।তিনি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এডিশনেল ডেপুটি চীফ অব স্টাফ এর দায়িত্ব পালন করেন।সে সময়(যুদ্ধের সময়)আমার বয়স ছিল প্রায় পনেরো বছর।যেহেতু বাবা সামরিক কর্ম কর্তা ছিলেন।তাই স্বাভাবিকভাবেই বাবার চাকরিটি ছিল বদলির । সব সময় পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদের যাওয়া আসা ছিল। আমার আব্বা যখন যেখানে যেতেন সেখানে বাগান, মুরগী, গরু এসব করতেন তাই ছোট বয়স থেকে ই এসব এর সাথে আমার বেড়ে উঠা।

 

 

আর্মি অফিসার দের সব রকম কাজের লোক সরবরাহ করা হলেও আমার আব্বা আমাদের দিয়ে সব রকম কাজ করাতেন তার মধ্যে বাগান করা বাধ্যতা মূলক ছিলো রোববার ছুটির দিনে। ৬/৭ বছর বয়স থেকে বাগানের কাজ করতে করতে আব্বার উপর খুব অভিমান হতো মনে মনে আব্বাকে অভিশাপ দিতাম। এখন এই বুড়ো বয়সে যখন বাগানে কাজ করে মনে অনেক শান্তি পাই তখন দু চোখ বেয়ে অস্রু পড়ে আর উপলব্ধি করি আব্বার দু’টি হাত আমার হাতের উপর আর আমি মাটির কাজ করছি।

 

 

১৯৭৫ সালে আামার বিয়ে হয়। আমার শাশুড়ী ও খুব কর্মঠ ছিলেন উনিও বাগান করতেন, আমার বাগান করা কে অনেক ভালো ভাবে নিয়ে ছিলেন তাই বাগান করতে আমার কোন প্রতিবন্ধকতা আসে নাই। আমি ফুল ফল এ সব করতাম। ১৯৭৫ সালের ২৮ ডিসেম্বরে শ্বশুর বাড়ি থেকে আব্বার বাড়ি যাওয়ার সময় রাস্তায় একটা জারুল গাছের উঁচু ডালে একটা বেগুনি ফুল আমার নজর কাড়ে,তখন খুব আগ্রহ নিয়ে রাস্তার লোক জনের সাহায্যে ফুল সহ গাছটা সংগ্রহ করি। আ হা, সে যে কি আনন্দ, বলে বুঝাতে পারবো না। তখন কিন্তু জানতাম না যে এটা অর্কিড। আমার বৃক্ষ প্রেমকে শুধু সখের মধ্যে ই সীমাবদ্ধ রাখিনি। ১৯৮১ সালে হটাৎ মনে হলো নার্সারি করলে কেমন হয়। যেই ভাবা সেই কাজ। আম্বরখানায় আমাদের বাসার সামনে রাস্তা সংলগ্ন জমি ছিলো তখন শাশুড়ির সম্মতি নিয়ে সেখানে বনস্রি নার্সারি নাম দিয়ে ব্যবষা শুরু করি এবং পথ কলি শিশুদের ধরে ধরে এনে কাজ শিখাই। ওদের খাওয়া দাওয়া বেতন দিয়ে ও আমার ভালো আয় হতো। মাএ ১০ হাজার টাকা দিয়ে নার্সারি শুরু করি। ২০০২ সালে মারাত্মক ট্রেন এক্সিডেন্ট এ আমি ভিশন খারাপ ভাবে আহত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ি । এমতাবস্থায় আমার সাপলায়ার বরিশালের আব্দুস সালাম হাওলাদার কে আমার প্রানের চেয়ে ও প্রিয় বাগান হাত বদল করি। তখন আমার বাগানের ভেলুয়েশন করা হলে ১০ লক্ষ টাকা সাবস্ত করা হয় সে টাকা গরিব মানুষ বিধায় ১৮ বছরে পরিশোধ করে। এখন নার্সারির নাম “ফ্লাওয়ার টাইম নার্সারি”। শুধু আব্দুস সালাম হাওলাদার নয়, যাঁরা আমার নার্সারীতে কাজ শিখেছিল তাঁরা অনেকেই এখন নার্সারী ব্যবসা করছে সিলেটের তামাবিল রোড এলাকায়।

 

 

২০১১ সালে আমি সিলেট এ আম্বরখানা ইস্টার্ন প্লাজায় ৫ দিন ব্যাপি একক বৃক্ষ প্রদর্শনী করি ফলজ, বনজ, অর্কিড, বনসাই সহ ৪০০ প্রজাতির গাছ নিয়ে। উল্লেখ্যে যে, এরকম বৃক্ষ প্রদর্শনী সিলেটে ছিল প্রথম যা আর কেউ করেছেন বলে জানা নেই । ২০১২ সালে শেরে বাংলা, এ, কে, ফজলুল হক গবেষণা পরিষদ আয়োজিত পুরষ্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে আমাকে অতিরিক্ত বৃক্ষ প্রেমি হিসেবে এওয়ার্ড দেওয়া হয়।

 

 

নার্সারী ছেড়ে দেয়ার পর ছাদ বাগান যেন আমার আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়ালো। আমি মনে করি আমরা যারা সবুজ কে ভালোবাসি, তাঁরা গাছের ভাষা বুঝি, গাছ আমাদের ভাষা বুঝতে পারে। আমি আমার ছোট্ট ছাদ বাগানে সব ধরনের গাছ লাগাই, যাতে ফুল দেখে মনের আনন্দ আর শাক সবজি, ফল মুল নিজে খেয়ে মানুষ বিলিয়ে দিয়ে আরেক রকম সুখ পাই।আমি লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারি না, তারপরও সকাল বিকেল মিলে কম হলেও ৫/৬ ঘন্টা ছাদে কাজ করে যে আনন্দ পাই, তা পৃথিবীর অন্য জগতে পাওয়া যায় না।অমরাবতির বৃক্ষ রোপন কার্যক্রমের ছবি ফেইসবুকে দেখে আমার মেঝ বোন খুব রাগ করে ফোন দিয়ে বলে বুবু “আপনি গাছ লাগাতে দুর দুরান্তে যান, আর আমরা আসতে বললেই আপনার পায়ের দুহাই ” আমি উত্তরে বলি,’ সে আনন্দ তোমরা বুঝবে না’।

 

 

সবার জন্য একটা কথাই বলবো আপনারা বারান্দায় ঘরের পাশের এক চিলতে মাটি তে ছাদে যে যেখানে পারেন ছোট্ট একটু সবুজের ছোয়া লাগিয়ে দেখবেন নেশা ধরে যাবে । সিলেটের আনাচে কানাচে অনেকেই অর্কিড করেতেন বেশ আগে থেকেই কিন্তু কেউ কাউকে চিনতাম না। ২০১৫ সালে আমরা ক’জন মিলে সিলেট অর্কিড সোসাইটি গঠন করি তখন আমার সাথে ডাঃ খূর্শিদা তাহমিন ছিলেন। আামাদের সোসাইটি আস্তে আস্তে ডাল পালা মেলে। ২০১৮ সালে আমরা সবাই মিলে মুসলিম সাহিত্য সংসদে ৩ দিন ব্যপি অর্কিড মেলা করি।অত্যন্ত সফল ঐ মেলায় অনেক লোকের সমাগম হয়ছিল। আমাদের সিলেট এ এখন ঘরে ঘরে সবুজ প্রেমিক। এসব দেখলে খুব শান্তি লাগে। আমাদের দেশে এখন আর মাটি নাই বললেই চলে, চারিদিকে ইট পাথরের দালান, তাই মানুষের মাঝে সবুজ প্রেম জাগানো খুবই জরুরী কাজ হয়ে দাড়িয়েছে।

 

 

 

পরিশেষে যে কথাটি না বললেই নয়,তাহলো গাছ, বাগান ও পরিবেশ নিয়ে অমরাবতি দেশ-বিদেশে যে ডাক দিয়েছিল,সেই ডাকে সারা দিয়ে বিগত ৩/৪ বছর ধরে আমরা সবাই অমরাবতির জন্য এগিয়ে এসেছি ,এবং দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছি। আমরা বিভিন্ন
স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে গাছ লাগনো থেকে শুরু করে,গৃহ নির্মাণ, গৃহ নির্মাণের সরঞ্জাম এমনকি ত্রান সামগ্রী পর্যন্ত বিতরন করে আসছি ।কিন্ত হঠাৎ করে জানতে পারলাম অমরাবতির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান শেবুল চৌধুরী মামা অনেক গুরুতর অসুস্থ। দোয়া করি আল্লাহ যেন উনাকে সুস্থতা দেন, উনার সপ্নের অমরাবতির জন্য উনাকে সাথে নিয়ে আমরা কাজ করতে চাই। মহান আল্লাহ যেন আমাদের দোয়া কবুল ও মন্জুর করুন। আমিন।