সৈয়দ ইকবাল এর- ‘রক্তাক্ত প্রতিজ্ঞা’ পুস্তক পর্যালোচনা-মোনাওয়ার আহমদ

প্রকাশিত: ১০:২৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৬, ২০২৪ | আপডেট: ১০:২৩:অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৬, ২০২৪

 

বইয়ের তথ্যভিত্তিক কিছু মৌলিক বিবরণ:-

বইটি প্রথম প্রকাশ পায় ২০১৩ সালে। দ্বিতীয় প্রকাশ হয় ২০২২ সালে। প্রকাশক: দৃষ্টি’ প্রকাশনা, বিজয় সরণি, ঢাকা-১২১৫। ৮০ পৃষ্ঠা সম্বলিত পুস্তকটি শক্ত-মলাটে বাধাইকৃত, এবং এর ক্রয়মূল্য ২৫০ টাকা নির্ধারিত। বইয়ে

র পিছনের মলাটের ভিতর অংশে কবির ফটো ও তার পরিচিতি সংযোজিত, এবং বইটি কবির পিতা-মাতার নামে উৎসর্গীত।
বইটিতে সর্বমোট ৬৩টি কবিতা স্থান পেয়েছে। এর ত্রয়োদশ কবিতার শিরোনাম হচ্ছে, ‘রক্তাক্ত প্রতিজ্ঞা’ এবং এটিকেই পুস্তকের নাম হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। লেখাগুলো ১৯৮০ থেকে ২০০০ সালের বিভিন্ন সময়ে রচিত। প্রথম কবিতা ১৯৮০ সালের। তখন কবির বয়স সতেরো। তারপর সময়ের ধারাবাহিকতায় বাকি লেখাগুলো রচিত হয়েছে।

কবিরা যেহেতু সমাজেরই লোক তাই তাদের লেখায় কালীন রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা ও চলমান বিতর্কের প্রতিফলন  প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেও এসে থাকে। এই গ্রন্থেও তাই হয়েছে।  গ্রন্থটির নামকরণ থেকেই গৌরবময় একাত্তরের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়। লেখাগুলোর রচনাকালীন দশকদ্বয়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটে যেসব আলোচনা তোলপাড় হচ্ছিল সেগুলো কখনো প্রতীকীতে, কখনো ইঙ্গিতে এবং কখনো সরাসরি লক্ষণীয়।

সমালোচনার দৃষ্টিতে প্রথম যে কথাটি বলা যেতে পারে তা হল লেখাগুলো বিষয়ভিত্তিক ক্যাটাগরিতে সাজানো নয়। শ্রেণী-বিন্যাস্ত লেখায় পাঠ্য-সুবিধা থাকে। আমরা আশা করব আগামী সংস্করণে হয়ত তা বিবেচনা করা হবে।
বইয়ের সার্বিক বিষয়বস্তু বইটি হাতে তোলে নিয়ে তার কবিতাগুলো পাঠ করলে সহজেই দেখা যাবে যে কবি দেশকে নিয়ে ভেবেছেন, সমাজকে নিয়ে ভেবেছেন, পিতামাতাকে নিয়ে ভেবেছেন, দেশ ও দশের মূল্যবোধ নিয়ে ভেবেছেন। কবিতায় এমন ভাবনাগুলোর স্থান দেয়া হয় বলে আমাদের মূল্যবোধ বেঁচে থাকে।

লেখার বিষয়গুলো নানান ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়েছে। কোথাও ছন্দবদ্ধ আকারে এসেছে, আবার কথাও ছন্দহীন। তবে প্রত্যেকটি কবিতার সারবস্তু তার শিরোনামের আওতাতেই থেকেছে। এতে বিষয়বস্তুর ফোকাস আপন স্থানেই রয়েছে। দেশ প্রেমের কবিতাগুলোতে সার্বজনীন আবেদন রয়েছে। সংস্কৃতি বিষয়ক কবিতাগুলোতে বর্তমান ও অতীতের পার্থক্য এবং ধারণাগত খুঁটিনাটি তফাৎ স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

 

এই সংকলনের লেখাগুলো কবির প্রাথমিক যৌবনের। তার বয়স্ক জীবনের কবিতাগুলোর তুলনায় এগুলোতে অন্য মাত্রার ছাপ এসেছে। নতুন ধরনের ভাব প্রকাশ পেয়েছে। এক্ষেত্রে আমার পছন্দের একটি কবিতার উল্লেখ করতে পারি। আর সেটি হল “ক্ষণিকের বিদায়”। কবি বলছেন, “কোথায় সে তরুলতা, কোথায় সে কথা/একি ছিল চিরজনমের প্রথা। ভুলিতে পারি না সখি, ভুলিব না আর/ব্যথাতে আজ হয়েছে হৃদয়ভার।” এখানে ভাব যেন ক্লাসিক্যাল কবিতার মত প্রশস্ত হয়েছে, এবং এতে চলে-যাওয়া-কালের সাথে হারানো-ভাব ও স্মৃতির সংযোগ ঘটানো হয়েছে।

কিছু উদাহরণমূলক আলোচনা:
রক্তাক্ত প্রতিজ্ঞা: “রক্তাক্ত প্রতিজ্ঞা” কবিতাটিকে আমরা কেন্দ্রীয় কবিতা ভাবতে পারি। এতে স্বাধীনতাকে বিভিন্ন রূপকতায় উল্লেখ করা হয়েছে যেমন, “স্বাধীনতা! তুমি সদ্য ফোটা একগুচ্ছ রক্ত পলাশ/তুমি কান্নাভেজা মায়ের দীর্ঘশ্বাস/তুমি মুক্তির আনন্দের আশ্বাস!/স্বাধীনতা! তুমি রক্তে রঞ্জিত কৃষ্ণচূড়া/তুমি জন্ম দিয়েছো অরুণ ঊষা/তুমি রক্তাক্ত লাশের প্রতিজ্ঞা …।”
এই সাথে আরেকটি কবিতা উল্লেখ করতে পারি, “এরাই দেশ প্রেমিক”। এখানে বাংলার গৌরব ও সৌরভ হিসেবে স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের স্মরণ করা হয়েছে। তাছাড়া “হে রক্তস্নাত ভাষা” কবিতাটিও  এই আঙ্গিকের। এতে ভাষা সৈনিকদের স্মৃতি, গৌরব ও চেতনা চিত্রায়িত হয়েছে। কবি বলেন, “ওরে প্রাণাহত বীর ছাত্র! ওরে বীর সৈনিক/হে রক্তস্নাত ভাষার সত্যিকার প্রেমিক/তোদেরই রক্ত করেছে আমাদের সম্পৃক্ত/তোদেরই চেতনায়  হয়েছে শত্রুমুক্ত।“
১৯৮৮ সালে রচিত কবিতা ‘বিশ্রুত যে নাম’। তখন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসন আমল। এই কবিতায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিই আলোচিত। বলা হয়েছে, “সে-ই বাংলার পিতৃপুরুষ, স্বাধীনতার স্থপতি/মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব/বিস্মৃত যে নাম বাংলার ইতিহাসে …।”  সম্ভবত ১৯৮০ দশকের রাজনীতির আলোকেই এমন চিন্তার উন্মেষ। সেদিনের সশ্যিয়াল মিডিয়ায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সম্ভবত কম আলোচনা হচ্ছিল। তবে এ নামটি যে অবিস্মরণীয় থাকবে এটাই নিশ্চিত বলা হয়েছে, কারণ এই নামটি “শিরায় উপশিরায় প্রবহমান”।

১৯৯০ সালে “জনতার জয়, অব্যয়-অক্ষয়” রচিত। এর বিষয়বস্তু হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। বলা হয়েছে, “৮৩র ফেব্রুয়ারীতে রাস্তায় নেমেছি/স্বৈরাচার হটাতে/মাথা পেতে নিয়েছি লাটিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস/এমনকি যাবতীয় নিপীড়ন-নির্যাতন/[…] তার ঠিকানা হবে ‘কারাগার’/নয়ত আস্তাকুড়ে।” এগুলো সেই ১৯৮০’র দশকের রাজনৈতিক স্মৃতি জড়িত।
“উত্তর প্রজন্মের কথা” কবিতাটি স্বাধীনতাত্তোর সামাজিক দুর্বৃত্তি ও দুর্বৃত্তায়ন বিষয় নিয়ে রচিত। বলা হয়েছে, “আমি যদি হই প্রজন্ম ’৭১/কিংবা তারও পরবর্তী/তাহলে কী করে জানবো/মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস?/তোমরা তো একে মিথ্যাচারে/সাজিয়েছো যার যার সুবিধামতো। … যে যুদ্ধে পঙ্গু হয়েছে/হারিয়েছে বেঁচে থাকার সমস্ত যোগ্যতা/দারিদ্রের কষাঘাতে নিষ্পেষিত মানুষ/হত্যা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ঘুষ আর সন্ত্রাসে/সংক্রমিত যে বাংলা ―এর কি ‘গতি’ হবে না একটা কিছু?”
ধর্ম বিষয়কও দুই-তিনটি কবিতা এই সংকলনে স্থান পেয়েছে, যেমন ঈদ ও  মোহররম। প্রথমটিতে গতানুগতিক ঈদের আনন্দ, নতুন পোশাক-আশাক, সাম্য-মৈত্রী ইত্যাদি আলোচিত এবং দ্বিতীয়টিতে হাসান-হোসেনের শোক আর ‘হায়-হোসেনের-মাতম’ প্রথার কঠোর সমালোচনা এসেছে।

সংস্কৃতি, স্মৃতি, প্রেম
সংস্কৃতি, স্মৃতি, প্রেম ইত্যাদি নিয়ে অনেক কবিতা স্থান পেয়েছে। ‘পহেলা বৈশাখ’, ‘স্মৃতিচিহ্ন’, ‘তুমি এবং তোমার চিঠিগুলো’ সেগুলোর অন্যতম। “পহেলা বৈশাখ” কবিতায় বৈশাখী পালনের চিত্রটি টানা হয়েছে। দিনের শুরু থেকে বিষয়টি এভাবে, “চৈত্র সংক্রান্তির রাত ফুরিয়ে যেই না হলো শেষ/নূতন ভোরে আলো শুধু খুশীরই আবেশ।” ছোটদের মেলার কেনা-কেটা এভাবে, “ মেলা থেকে আনবে বেলুন আনবে পাতার বাঁশি/ঘুড়ি তো আর আনতেই হবে, নইলে মেলাই যে বাসী।” হালখাতার উৎসব এভাবে, “নূতন সাজে সাজছে দোকান ‘হালখাতা’ উৎসব/ মিষ্টি খাবে, পাওনা মিটাবে, হিসেব হবে নূতন সব।” তারপর ঐতিহ্যের ধারণা “ঐতিহ্যেরই নানা পার্বণ, হয় যে বাংলায় প্রাণময়/আনন্দের এই ফল্গুধারা বহুক সারা বছরময়।”
“স্মৃতিচিহ্ন” কবিতায় প্রবক্তা (persona) তার বিরহ-বিজড়িত প্রেমানুভূতির দ্বান্দ্বিকতা প্রকাশ করেন, “আমি মুছে ফেলতে চাই/তোমার সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন/ঝেড়ে ফেলতে চাই/মনের আঙিনা থেকে তোমার অনুভব/ভুলে যেতে চাই চিরতরে/তোমাকে, কেবল তোমাকে।” কিন্তু “তুমি এবং তোমার চিঠিগুলো” কবিতায় এ-দ্বন্দ্ব অন্যভাবে প্রকাশ পায়। যেমন, “তোমার চিঠিগুলো পুড়িয়ে ফেলব/কিংবা ভাসিয়ে দেবো খোয়াইয়ের জলে।” কিন্তু না সেটা আর খোয়াই নদীর জলে ভাসানো হয়না, বরং উলটোটাই করা হয়, এভাবে: “চিঠিগুলো পুষছি সযত্নে।”  [তারপর উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, জানার আগ্রহ] “… জানি না কেমনে আছো/কাঙ্ক্ষিত P-কে পেয়েছো কি-না/বড্ড কষ্ট হয় ভেবে।” এভাবেই প্রেম, স্মৃতি, বিরহ, অতীত সবকিছুই শব্দ ও বাক্যের ছন্দে বা ছন্দাবন্ধত্বের বাইরে মুক্তি লাভ করে।

মা-বাবার স্মৃতি
মা-বাবার নামে উৎসর্গিত পুস্তকে অবশ্যই মা-বাবাকে নিয়ে স্মৃতি-চারণ থাকবে। “বাবার আদেশের বেড়া” কবিতায় বাবাকে আত্মপ্রত্যয়ী, আদর্শ-পুরুষ হিসেবে উল্লেখ হয়েছে। সব জীবনের মত বাবার জীবনেও অকৃতজ্ঞ লোকের দুশমনির ঘটনাও ছিল, কিন্তু নানান পীড়নের মোকাবেলায় তাকে ধৈর্যশীল পুরুষ হিসেবে পাওয়া গিয়েছে। কবি বলেন, “তোমার ইজ্জত-লুটার নীল নকশায় যারা ছিল বিভোর/তাদের আঁধার রাজ্যে আজো হয় না সত্যের ভোর।/যাকে পরম মমতায় পুষেছিলে সযত্নে/সে-ই এখন তোমার গোষ্ঠী-উদ্ধারে মত্ত।” পিতার মৃত্যু-কালে কিছু না-বলার কথাও আক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ হয়েছে, “তোমার শেষ যাত্রায় কাছে থাকলেও /জানতে দিলে না তোমার ‘শেষ উপদেশ’/তাহলে এখন কার কাছে যাবো, বলো!”
কবির মাতৃ-বিয়োগেও সেই অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল। কবি বলেন, “তোমার অন্তিম শয্যার সান্নিধ্যের তাগিদ/ভ্রূক্ষেপ করেনি সন্ত্রাসীর চকচকে ফলা/তবুও জানি না কোন অপরাধে/তোমার ‘শেষবাণী’ থেকে করলে বঞ্চিত!” (‘বিদায়ী মা আমার’ )। ‘বিদায়ী মা আমার’ কবিতায় মায়ের জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করা হয়েছে, “প্রার্থনা করি, স্বর্গরাজ্যের পুষ্প-ওমে/সিক্ত হোক তোমার অনন্ত জীবন!” (প্রাগুক্ত)।

সারাংশ

সারাংশে আমাদেরকে কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তুর কথা আবার উল্লেখ করতে হয়। এখানে দেশ-প্রেম, বাঙ্গালি সংস্কৃতি, প্রথা ইত্যাদি ছাড়াও প্রেমের কবিতা, কবির শিক্ষাপীঠ নিয়ে কবিতা, প্রকৃতি নিয়ে কবিতা, বাঙালী জীবনবোধসহ অনেক বিষয় একই পুস্তকে সন্নিবেশিত হওয়ায় সমালোচকের জন্য সংক্ষেপে আলোচনা কঠিন হয়ে পড়ে। আমরাও দীর্ঘতার কথা ভেবে অনেক কবিতার বিষয়বস্তু আলোচনার বাইরে রাখতে হয়েছে। তবে সার্বিকভাবে কবিতাগুলো নতুন পাঠকের কাছে অনেক শিক্ষণীয় ধারণা তোলে ধরবে এবং বয়স্ক পাঠকের সামনে চিন্তার খোরাক উপস্থাপন করবে ―এই আশা পোষণ করি।

আমরা আরও আশা করি যে কবিতা পাঠের সংস্কৃতিতে এই কবিতাগুলো দেশ-প্রেম ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ভূমিকা রাখবে এবং আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।

 

-মোনাওয়ার আহমদ
লেখক ও সাহিত্য-সমালোচক