যেভাবে মুদি দোকানদার থেকে সিরিয়াল কিলার ছদ্মবেশী বাউল শিল্পী

প্রকাশিত: ১:১৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৪, ২০২২ | আপডেট: ১:১০:পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১৪, ২০২২

অনলাইন ডেস্ক : ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর হেলাল এলাকায় মুদি দোকানদারী শুরু করে। একসময় হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে পড়লে এলাকায় তার কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বাউল ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ানো এই সিরিয়াল কিলার খ্যাত দুর্ধর্ষ ফেরারি আসামি মো. হেলাল হোসেন ওরফে সেলিম ফকির ওরফে বাউল সেলিমকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কাওরানবাজার র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, বিভিন্ন সময় একাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে প্রায় ৭ বছর বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ফেরারি জীবন-যাপন করছে সে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছদ্মবেশ ধারণ করে অবস্থান করত সে। ছদ্মবেশ অবস্থায় একসময় বহুল জনপ্রিয় ‘ভাঙ্গা তরী ছেড়া পাল’ শিরোনামের গানের বাউল মডেল হিসেবে তাকে দেখা যায়।

খন্দকার আল মঈন আরও জানান, আনুমানিক ৬ মাস আগে এক ব্যক্তি ইউটিউবে প্রচারিত একটি গানের বাউল মডেল সম্পর্কে র‌্যাবের নিকট তথ্য প্রদান করে যে, এ মডেল সম্ভবত বগুড়ার বিদ্যুৎ হত্যা মামলার আসামি। এরই প্রেক্ষিত বিষয়টি নিয়ে র‌্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে। এক পর্যায়ে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে র‌্যাব নিশ্চিত হয়। পরে র‌্যাব এ আসামিকে গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।

এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব-৩ এর অভিযানে বুধবার  (১২ জানুয়ারি) রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন এলাকা হতে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

র‌্যাব জানায়, হেলাল হোসেন ২০০১ সালের বগুড়ার চাঞ্চল্যকর বিদুৎ হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ফেরারি আসামি এবং আরও ২টি হত্যা মামলার আসামি। ১৯৯৭ সালে বগুড়ার বিষ্ণু হত্যা মামলা এবং ২০০৬ সালে রবিউল হত্যা মামলার আসামি বলেও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়।

র‌্যাব আরও জানায়, ১৯৯৭ সালে বগুড়াতে চাঞ্চল্যকর বিষ্ণু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। গ্রেফতারকৃত হেলাল ২১ বছর বয়সে উক্ত হত্যা মামলার এজাহারনামীয় আসামি ছিল। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয় বলে জানা যায়। এভাবেই সে বিভিন্ন অপারাধমূলক কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হতে শুরু করে এবং এলাকায় দুর্ধর্ষ হেলাল নামে পরিচিতি পায়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত আরও জানায়, ২০০০ সালে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এলাকায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে প্রতিপক্ষের ধারালো দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে তার বাম হাতে মারাত্মক জখম হয় এবং বাম হাত পঙ্গু হয়। এই ঘটনার পর হতে সে বিভিন্ন নামে যেমন- দুর্ধর্ষ হেলাল, হাত লুলা হেলাল হিসেবে এলাকায় পরিচিতি লাভ করে।

২০০১ সালে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মাহমুদুল হাসান বিদ্যুৎ (২০), পূর্বপরিকল্পিতভাবে দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভিকটিমের পরিবার বাদী হয়ে বগুড়া সদর থানায় মামলা হত্যা মামলা দায়ের করেন; যার  মামলা নং-০২(১০)২০০১; ধারা-৩০২/৩৪। এ মামলায়  আদালত তাকে যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করেন।

২০০৬ সালে বগুড়াতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রবিউল নামক এক ব্যক্তিকে দুর্বৃত্তরা দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গ্রেফতারকৃত হেলাল উক্ত হত্যাকাণ্ডের একজন চার্জশীটভুক্ত আসামি। গ্রেফতারকৃত হেলাল ২০১০ সালে বগুড়া সদর থানায় দায়েরকৃত একটি চুরির মামলায় ২০১৫ সালে গ্রেফতার হয়। একই সাথে ২০০১ সালের বিদ্যুৎ হত্যা মামলার বিচারকার্যও চলমান থাকে। ২০১৫ সালেই এ চুরির মামলায় সে জামিনে মুক্ত হয় এবং একই দিনে বিদ্যুৎ হত্যা মামলায় আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। এছাড়াও, ২০১১ সালে তার বিরুদ্ধে বগুড়া সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা রয়েছে।

র‍্যাব জানায়, তার বিরুদ্ধে ২০১০ সালে দায়েরকৃত চুরির মামলায় ২০১৫ সালে জামিন প্রাপ্তির দিনে বিদ্যুৎ হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হলে সে সু-কৌশলে এলাকা ত্যাগ করে এবং ফেরারি জীবন যাপন শুরু করে। প্রথমে সে বগুড়া থেকে ট্রেনযোগে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে আসে। পরে কমলাপুর হতে ট্রেনযোগে সে চট্টগ্রামে চলে যায় এবং সেখানকার আমানত শাহ মাজারে ছদ্মবেশ ধারণ করে বেশ কিছুদিন অবস্থান করে। সেখান থেকে ট্রেনযোগে সিলেটের শাহজালাল মাজারে চলে যায়। সিলেটে গিয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করে আরও কিছুদিন অবস্থান করে।

জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে সে বাংলাদেশের বিভিন্ন রেলস্টেশন ও মাজারে ছদ্মবেশে অবস্থান করত। সে কিশোরগঞ্জ ভৈরব রেলস্টেশনে নাম-ঠিকানা ও পরিচয় গোপন রেখে সেলিম ফকির নাম ধারণ করে। আনুমানিক ৫ বছর পূর্বে গ্রেফতারকৃত হেলাল নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনে কিশোর পলাশ ওরফে গামছা পলাশ এর একটি গানের শুটিং চলাকালে রেললাইন এর পাশে বাউল গান গাচ্ছিল। তখন শুটিং এর একজন ব্যক্তি তাকে গানের মিউজিক ভিডিওতে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলে বহুল জনপ্রিয় ‘ভাঙ্গা তরী ছেড়া পাল’ শিরোনামের গানের বাউল মডেল হিসেবে তাকে দেখা যায়।

সে প্রায় ৭ বছর যাবৎ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ফেরারি জীবন-যাপন করছে এবং গত প্রায় ৪ বছর যাবৎ কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলস্টেশনের পাশে একজন মহিলার সাথে সংসার করে আসছে। বিভিন্ন রেলস্টেশনে সে বাউল গান গেয়ে মানুষের নিকট হতে সাহায্য নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত।