।। লক ডাউনের উন্মুক্ত ছায়া ।। অনুবাদে: জন্মেজয় রেবা দুলু

প্রকাশিত: ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১৪, ২০২২ | আপডেট: ৫:২৮:পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১৪, ২০২২

একটি জীবানু এবং তাই যথেষ্ট যা পূর মানব জাতিকে বাধ্য করেছে তালাবদ্ধ অবস্হায় নিজেকে সুরক্ষিত করতে। আমাদেরকে ঠেলে দেয়া হয়েছে মহামারির কবলে। যার ছোবলের যন্ত্রনার প্রবনতার মাত্রা এই প্রজন্ম কোনদিন সম্মুখীন হয়নি। জীবনের যে স্বাভাবিক যাপন তাকে করে তুলেছে অনির্দিষ্টকালের জন্য অনিশ্চিত।
ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, রাজনৈতিক মতভেদ সবকিছু উপেক্ষা করে পুরো মানব জাতিকে করেছে এক। যেটা মাঝে মধ্যে সিনেমার রুপালি পর্দায় প্রতিভাত হয়। মনে হয় যেন ভিন্ন গ্রহের মহাকাশ যান পুরো আকাশটাকে ঘিরে প্রিথিবীটাকে অন্ধকার করে দিয়ে মাথার উপর ঘুরছে। প্রশ্ন জাগে এই মহা দুর্যোগের সময় যদি আমরা এক হতে পারি, তবে সুসময়ে তা সম্ভব হয়না কেন? এ ধরনের এই অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের মোটেই প্রস্তুতি ছিলনা, যে কারনে প্রতিটি দিন কোনরকম ভাবে অতিবাহিত করতে হচ্ছে। সেই সাথে পরিকল্পনা করতে হচ্ছে পরের দিন কিংবা আগামি সপ্তাহ গুলোর। গতকাল ঞবংপড় তে ছিল উদ্বেগজনক অবস্হা। সরকার স্কুলগুলো অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধের ঘোষনা দেয় এর আগের দিন । আমি দুধ কেনার জন্য যাই কিন্তু ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। ঞবংপড় এবং ঈড়-ড়ঢ় এর থাডিয়া গুলো খালি পড়ে ছিল। বাডি থেকে কাজ করার এটাই ছিল প্রথম দিন তাই আমি আর অন্য কোন যায়গায় দুধ কিনতে যেতে পারিনি, আমায় বাড়ি ফিরতে হয়েছে ।
ঐদিনই কিছুক্ষন পরে আমার মেয়েদেরকে স্কুল থেকে আনতে যেতে হয়। আমার দুই মেয়ে এবং আমি গাড়িতে বসা। অনুসন্ধিৎসু, উ্ৎকনিঠত কোমল মনের একটার পর একটা প্রশ্ন এবং তাৎক্ষনিক উত্তরের প্রত্যাশা; এই অনিশ্চিত অবস্হার শেষ কখন? স্কুল খুলবে কবে? গৃস্মের ছুটির আগেকি আমরা স্কুলে যেতে পারবো? এঈঝঊ বীধস এর কি হবে?
এই শুক্রবার কি আমার ুবধৎ ৬ এর শেষ দিন হবে? আমি কিভাবে আমার এঈঝঊ পঁৎৎরপঁষঁস শেষ করব? তাহলে কি আমার ঋৎধহপব এ স্কুল টোরের কি আগামি বছর হবে? আমার ড়িৎশ বীঢ়বৎরবহপব ঢ়ষধপবসবহঃ এর কি হবে? আমি একের পর এক সবগুলো প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে বাড়িতে ঢুকলাম এবং স্কুল পরবর্তি দৈনন্দিন কার্য্যক্রমে মনোনিবেশ করলাম। আমার প্রচেষ্টা ছিল যতদুর সম্ভব সত্যাবলমবন করা এবং তাদের মানষিক উচ্ছাসে ভাটা না দেয়া: যে দক্ষতা টুকুন প্রতিটি দক্ষ অভিভাবকের প্রতিনিয়ত প্রয়াশ।

একটি প্রশ্নের উত্তরে তারা এবং আমি নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে যাই। অনুসন্ধিৎসু কিশোর মন সর্কদাই অবহেলিত। সহসাই আমি তাদের প্রশ্নের ফাঁদে অজান্তেই পা দেই; যখন পা ফিরিয়ে নেবার কোন সুযোগ থাকেনা। মনের বদ্ধ দরজা কিভাবে যেন খুলে যায়। তাদের প্রশ্ন ছিল “ তুমি কি জীবনে কখনো এ ধরনের অবস্হায় পড়েছিলে মাম্মা? “ আমি শুনলাম, ভাবলাম, তারপর বললাম , না ঠিক একই রকম নয় তবে আমাদের স্কুলও পুরো এক বছরের জন্য বন্ধ ছিল, লোকজন দিনের পর দিন মাসের পর মাস ঘরবাড়ি ছেড়ে বের হতে পারেনি কারফিউর জন্য”। আমাকে ব্যাখ্যা দিতে হল কারফিউ এবং ব্ল্যাকআউটের। আমাকে তাদের সেই ভিত সন্ত্রস্ত চেহারার সামনে অবচেতন মনেই বর্ণনা দিতে হয়েছে কিভাবে নিরীহ মানুষদের নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা করা হয়েছে শুধুমাত্র তাদের জাতিগত পরিচয়ের জন্য। “তোমার জানামত কেউ কি খুন হয়েছিল?” তারা জিজ্ঞেস করল।, “হ্যা আমাদের প্রতিবেশি”, আমি বল্লাম। অত্যন্ত নম্র স্বভাবের সেই মানুষটি রাস্তার পাশে ছোট একটি দোকানে পাকড়া বিক্রি করতেন। তার পরিবারে ছোট দুটো বাচ্চা ছিল। ভয় তাদেরকে অভিভুত করে ফেলে, যখন তারা জানতে পারে যে, তাদেরই একজন কাকুকে, তার দোকান থেকে জোর করে বের করে নিয়ে এমন এলোপাতাড়ি ভাবে মারধোর করা হয়, যে তাকে হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পান্জা লডতে হয়েছিল। তাদের চোকগুলো বিস্ময়ে বড় হতে থাকে, যখন শুনতে পায়, যে তাদের বাবা এবং আমাকে একদল যুবক চামড়ার তৈরী জ্যাকেটের ভিতরে লোকানো চাকু নিয়ে আক্রমণ চালায় এবং ভাগ্যক্রমে পালিয়ে আমরা প্রাণরক্ষায় সমর্থ হই।

“কিন্তু কেন মাম্মা? তোমরা কি তোমাদের নিজের দেশে ছিলে না? মানে ইন্ডিয়াতে?” আমি বল্লাম , হ্যা আমরা আমাদের স্বদেশেই ছিলাম। কিন্তু আমরা হলাম ২য় প্রজন্মের হিন্দু বাঙ্গালী, বাংলাদেশী শরনার্থি । আমরা ঊপজাতি নই কিন্তু বসবাস করছিলাম যেখানে সেটা হল ঊপজাতি অধ্যুষিত এলাকা এবং তা ছিল অগ্রহনযেগ্য। আমাকে তাদের সেই জটিল ইতিহাস যা বাংলার বিভাজন থেকে শুরু , যা আমার মাতা এবং পিতা মহোদের প্রান বাচানোর তাগিদে, নিজের বাস্তভিটা, নিজের দেশ যা এখনকার বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতের উত্তর পশ্চিমের প্রদেশ নেঘালয়ের রাজধানি শিলংয়ে, শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। কিভাবে তারা এই ইন্ডিয়াতে আসার পরেও তাদের এবং তাদের বংশধরদের কোন নিরাপঁত্তা মেলেনি। তাদেরকে বল্লাম শিলংয়ে আমরা যখন বড় হয়েছি আমাদের প্রতিনিয়ত সম্মুখীন হতে হয়েছে বৈষম্যের। আমরা সমঅধিকার হতে হয়েছি বন্চিত। আমাদেরকে অপদস্ত এবং অমর্যাদা করার লক্ষে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হত , যেমন “আখাড” মানে বহিরাগত। আমাদের বাডিঁঘর কিংবা জায়গা জমি কেনার অধিকার ছিলনা সেই সাথে দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে বিভিন্ন শত্রুতার স্বীকার হতে হত। আমি তাদেরকে বল্লাম ১৯৭৯, ১৯৮৭ এবং ১৯৯০ সালের গন্ডগোলের সময় বাঙ্গালী পরিবার গুলোকে আবারো শিলং ছেড়ে পালাতে হয়। তারা বুঝতে সক্ষম হয় যে কেন আমার বাবা মা তাদের দাদূ দিদাদের শিলং থেকে কোলকাতায় স্হানান্তরিত হতে হয়।কথাগুলো ওদের বলার সময় আবেগ আমার কন্ঠকে ভারি করে করে তুলছিল । ভারি গলাতেই তাদেদরকে বল্লাম যে তারা হল চতুর্থ প্রজন্মের বাস্তভিটাহীন যাযাবর বাঙ্গালী।
আমরা হলাম অভিবাসীদের জনতাতাত্বিক পরিসংখ্যানের সত্যতা, উদ্বাস্তু হিসাবে রাজনৈতিক সত্যতা, অনাকাংখিত হবার অনুভুতির সামাজিক সত্যতা, নিজস্ব বাসস্হান যাকে নিজের বাড়ি বলার মানষিক চাহিদার সত্যতা।
আমায় শুনে আমার মেয়েরা অত্যাশ্চার্য । তার সোচ্চার কন্ঠে বলে উঠে “এ হল সন্ত্রাসবাদ” , তাদের অবয়বে ছিল অভিযোগের আবাস। “কিন্তু তুমি আমাদের এসব ব্যাপার আগে বলনি কেন?” তাদের জিজ্ঞাসু চাহনিতে বিস্ময় এবং কৌতুহল। “কিভাবে তুমি এসব ভয়ংকর ঘটনা গুলো এত সহজভাবে আমাদের বলছ? মনে হয় যেন কোন এক সিনেমার গল্প শুনছি এবং ঘটনাটা অন্য কাউকে নিয়ে” আরো বল্ল “ আমরা কেন এসব ঘটনা জানিনা? কেন পৃথিবির বাকি দেশগুলোকে এসব ঘটনা গুলো জানানো হয়নি? আমরা হলোকস্ট সম্পর্কে জানি, ভিয়েতনাম্র যুদ্ধ জানি, বিশ্বযুদ্ধ এমনকি একজন মানুষ ইংল্যান্ড কিংবা আমেরিকায় খুন হলে পুরো বিশ্ববাসি মুহুর্তের মধ্যে জেনে যায়! কিভাবে বাকি ভারতবর্ষ একটা জাতির বিরুদ্ধে বছরের পর বছর এ ধরনের পৈশাচিক অত্যাচারের
কথা জানতে পারলনা? কেন ভারত এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাডায়নি? কেন ন্যায় বিচারের দাবিতে উঠে দাডায়নি? কেন তুমি এসব নিয়ে কথা বলনি মা?

সেই পৈশাচিকতাকে সহ্য করার জন্য, নিস্পৃহতা আর আবেগহীহনতার যে দেয়াল বাংগালিরা তৈরী করেছিল়; অবিশ্বাশ্যতায় ভরা আমার মেয়েদের চোখ আমার সেই হ্হৃদয়ের লোহার দেয়ালটাকে ফোঁট করে দিচ্ছিল ।আমরা যারা প্রতিবাদ করিনি মুলত জানা ছিলনা যে আমাদেরও প্রতিবাদ করার অধিকার আছে। আমরা ভয় নামক একটি আবর্তে ছিলাম, চরম নমনিয়তা প্রদর্শনের কোনভাবে ..,,, বেত ছিলাম যতক্ষন পর্য্যনতনা আমরা শিলং বেরুতে পেরেছিলাম এবং নিজস্ব সম্মান বোধটা ফিরে পেয়েছিলাম। আমরা শিলং ছাড়ার সাথে ছেড়ে এলাম আমাদের সাথে যে অন্যায় অত্যাচার হচ্ছিল তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার দায়িত্ববোধ, যে অন্যায় অত্যাচারের উত্থান মানবিকতার বিরুদ্ধে যার কারন সংকির্ন বর্ণবাদ এবং জাতিগত অনিশ্চয়তা । আমরা ছিলাম পরিশ্রান্ত। আমরা চলে এসেছি নিরাপত্তা এবং নিশ্চয়তা পেতে আর কখনও ফিরে না তাকাতে হয় সে ই অন্ধকার দিন গুলোর দিকেযা আমাদের স্মৃতিতে আর দুঃস্বপ্নে তাডিয়ে বেড়ায়। আমি এবং আমার মত অনেকই যারা ক্রমাগত বর্ণবাদ জনিত কারনে নির্যাতিত হবার শংকা নিয়ে বড় হয়েছি; সেই অন্ধকার দিনগুলো আমাদের মধ্যে একটা চিরস্হায়ী ক্ষতের ছাপ রেখে গেছে যা হল এক আঘাত পরবর্তি চাপজনিত ব্যাধি এবং এ নিয়েই আমাদের বাকি জীবন কাটাতে হবে।

প্রয় ২০ বছর সময় আর প্রায় আট হাজার মাইলের ব্যবধান থাকা সত্যেও, আমার মেয়েদের শিলং সম্পর্কিত এই প্রশ্ন গুলো ছিল, ইংল্যান্ডের এই করনা রোগ জীবানুর প্রদুর্ভাবের অসনিসংকেতের চাইতেও বেশি কষ্টদায়ক।

মানব স্বাস্হ্যের আসন্ন চরম দুর্দশার ছায়ার ঊপেক্ষা করে আমার কানে আমার মেয়েদের সেই কথাগুলো অনুরণিত হতে থাকে “ মা তোমার এই নিয়ে কথা বলা উচিত। তোমার উচিত এই না বলা কথা গুলো বলা”।

 

মুল রচনা : সোনালি দত্ত